বছরদশেক আগে হঠাৎ একদিন সন্ধেবেলা শোকার্ত চেহারায় একটি কিশোর এসে হাজির হল।
“আমাকে চিনতে পারছেন?”
কালীপ্রসাদের বুদ্ধি, স্মৃতি ও অনুমানশক্তি অত্যন্ত প্রখর। তিনি চিনতে পেরে চমকে উঠে বললেন, “তুই তো রকি! কী হয়েছে?”
রকি অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করল। তারপর মায়ের মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে বলল, “বাবার সঙ্গে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব। বাবা আমাকে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ান বক্সার করতে চায়। আমি তা চাই না। মা মারা যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেছে, তিনি যদি না বাঁচেন তবে তাঁর মৃত্যুর পর আমি যেন আপনার কাছে চলে আসি। কালীকাকা, আপনি আমাকে যদি আশ্রয় নাও দেন তবু দয়া করে বাবাকে আমার খোঁজ দেবেন না। বাবা তা হলে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে।”
কালীপ্রসাদ এই দুর্বলচিত্ত ছেলেটির সমস্যা বুঝতে পারলেন। বাবু মিত্তির যে জেদি ও অবুঝ মানুষ তাও তিনি ভালই জানেন। তাই বললেন, “তোর ভয় নেই। আমার কাছেই থাক। বাবু জানতে পারবে না।”
রকি সভয়ে বলল, “বাবা যদি খুঁজতে-খুঁজতে এখানে চলে আসে?”
কালীপ্রসাদ মাথা নেড়ে বললেন, “আসবে না। তার কারণ তুই যে কালীপুরের রাস্তা চিনে আসতে পারবি সেটাই তার বিশ্বাস হবে না। তুই তো বোধ হয় পাঁচ-ছয় বছর বয়সে এখানে শেষবার এসেছিস। চিনলি কী করে?”
“কালীপুর নামটা মনে ছিল। মা বলে দিয়েছিল। জিজ্ঞেস করে করে চলে এসেছি।”
কালীপ্রসাদ একটু চিন্তা করে বললেন, “এসে যখন পড়েছিস তখন আর ভাবনা নেই। তবে গাঁয়ে থাকার দুটো অসুবিধে আছে। নতুন লোক দেখলে গাঁয়ের মধ্যে কথা উঠবে আর সেটা ছড়িয়ে পড়তেও দেরি হবে না। দ্বিতীয় অসুবিধে হল, এখানে থাকলে তোর লেখাপড়া হবে না। কয়েকটা দিন থাক, তোর মায়ের শ্রাদ্ধশান্তি এখানেই কর। তারপর কিছু একটা ঠিক করা যাবে।”
কালীপ্রসাদ রকিকে কালীপুরে রাখেননি। তাঁর পয়সার অভাব নেই। তারা-ডাকাতের কল্যাণে সোনাদানা, হিরে-জহরত, রুপোর বাঁট, বাসনকোসন যা ছিল তার দাম লাখ-লাখ টাকা। পাপের রোজগার বলে কালীপ্রসাদ তাতে হাত দেননি, বিলিয়েও দেননি। তারাপ্রসাদের সেই গুপ্ত সম্পদ এবার রকির কাজে লাগালেন। তাকে দিল্লিতে পাঠিয়ে দিলেন লেখাপড়া করতে। পরে রকি নিজের মোগ্যতাতেই বিদেশে চলে যায়। সম্প্রতি সে ফিরে এসে কালীপ্রসাদের সঙ্গে দেখা করে। এখন সে মস্ত এঞ্জিনিয়ার। লম্বা-চওড়া চেহারা হয়েছে।
এসে বলল, “বাবা হয়তো এখনও আমার ওপর রাগ করে আছে। আমার হুট করে তাঁর কাছে যেতে সাহস হয় না। তবু আমি বাবাকে জানাতে চাই যে, আমি বেঁচে আছি এবং বক্সার না হলেও আমি আমার মতো হয়েছি।”
কালী প্রসাদ একটু ভেবে বললেন, “যতদূর জানি বাবুর শরীর ভাল নয়। পারকিনসন্স ডিজিজ হয়েছে। হার্ট খুব মজবুত নয়। হুট করে খবর দিলে হয়তো ভীষণ শক লাগবে। হঠাৎ করে আনন্দটাও ভাল ব্যাপার নয়। তুই ভাবিস না। খবরটা আমি সইয়ে-সইয়ে দেব’খন।”
রকি আমেদাবাদে তার কর্মস্থলে ফিরে গেল। কালীপ্রসাদ তাঁর পোষা দুটি শিক্ষিত পায়রা নিয়ে দেখা করতে গেলেন বাবুর সঙ্গে।
অনেক কথা হল দুজনে। কালীপ্রসাদ বুঝতে পারলেন, হারানো ছেলের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে আছেন বাবু মিত্তির। কিন্তু সেই উৎকণ্ঠাটা এতই প্রবল যে, ছেলের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবু মিত্তির হয়তো হার্টফেল করবেন।
সুতরাং কালীপ্রসাদ নানা কথা ফাঁদলেন। বললেন, “হ্যাঁ রে, তুই কি ভূতে বিশ্বাস করিস?”
বাবু মিত্তির অবাক হয়ে বললেন, “হঠাৎ ভূতের কথা কেন?”
“করিস কি না বল না।”
“আগে করতাম না। আজকাল মন্ত্র-তন্ত্র, ভূত-প্রেত সব বিশ্বাস করি। রকির খোঁজে আমি তো দু দফায় দু’জন তান্ত্রিককেও লাগিয়েছিলাম। জ্যোতিষীরাও কম পয়সা নেয়নি।”
“কালীপুরে সবাই বলে, আমার নাকি পোষা ভূত আছে।”
বাবু মিত্তির হাসলেন। বললেন, “সেটা শুনেছি।”
“বিশ্বাস করিস?”
“তোর যে পোষা ভূত আছে সেটা কি তুই নিজেই বিশ্বাস করিস?”
কালীপ্রসাদ খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, “যদি বলি আছে, বিশ্বাস করবি?”
বাবু মিত্তির হেসে বললেন, “তোর অনেক খ্যাপামি আছে জানি। ওই অজ পাড়াগাঁয়ে ল্যাবরেটরি বানিয়ে নানা আজগুবি এক্সপেরিমেন্ট করিস, গাঁয়ের লোক সেটাকেও ভৌতিক ব্যাপার বলে ভয় খায়। আমাকেও কি ওদের দলে ফেলতে চাস?”
“আমি কোনও আজগুবি এক্সপেরিমেন্ট করি না। বিকল্প বিদ্যুতের উৎস খোঁজার জন্য আমি প্রাণপাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কোটি-কোটি টাকা খরচ হচ্ছে এই গবেষণায়। মাটির নীচে কয়লা আর তেল ফুরিয়ে আসছে। একুশ শতকের গোড়ায় যদি বিকল্প শক্তির উৎস না বের করা যায় তা হলে মানুষের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমাদের অত টাকা নেই। আমি শস্তা এবং সহজ উপায়ে কিছু করা যায় কি না সেই চেষ্টা করছি। হয়তো লাভ হবে লবডঙ্কা, কিন্তু কাজ একটু এগিয়ে রেখে যাচ্ছি। তার রেকর্ডও থাকছে। যদি কেউ আমার কাজের ফাঁক-ফোকর-ত্রুটি শুধরে পরবর্তীকালে কিছু করতে পারে তাতে আখেরে মানুষের লাভই হবে।”
“সে তো বুঝলাম। কিন্তু এর মধ্যে ভূত আসছে কোথা থেকে?”
কালীপ্রসাদ হাসলেন। বললেন, “ভূতের ব্যাপারটা কিছুদিন হল ঘটছে। বিয়ে-টিয়ে করিনি, আমার সংসার বলতেও কিছু নেই। একা মানুষ তো, নানারকম বাতিক দেখা দেয়। আমি কিছুদিন আগে নিশুত রাতে একা-একা প্ল্যানচেট করার চেষ্টা করতাম। কীরকম করে করতে হয় তা জানি না। একা ঘরে বসে একটা মোম জ্বেলে খুব একাগ্রতার সঙ্গে আমার দাদু শিবপ্রসাদকে ভাবতে শুরু করি। রোজ একই প্রসেস। দিন-সাতেক রোজ একইভাবে তাঁকে চিন্তা করতে করতে এবং তাঁকে