পিস্তলটার দিকে চেয়ে তাঁর আজ সেইসব কথা দ্রুত মনে পড়তে লাগল। যদিও সঙ্গে পিস্তল রাখলে এখন আর বিশেষ লাভ নেই। ডেল্টা তাঁর পিস্তলের পাল্লায় বোকার মতো এসে তো হাজির হবে না। তবু চামড়ার শোলডার হোলস্টারটা বের করে গলায় পরে নিলেন। পিস্তলটা রইল বাঁ বগলের একটু নীচে, খাপের মধ্যে। গায়ে জামা থাকলে বাইরে থেকে বোঝাই যাবে না জিনিসটার অস্তিত্ব।
জামা গায়ে দিয়ে যখন দরজা খুলে বেরোলেন, তখন দেখলেন পলাশ বিবর্ণ মুখে বসবার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে।
“কাকাবাবু!”
বাবু মিত্তির শান্ত গলাতেই বললেন, “কী হয়েছে?”
“রাম পহলওয়ান তার ঘরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মুখে গ্যাঁজলা উঠছে। এখনই হাসপাতালে নেওয়া দরকার।”
বাবু মিত্তির দুঃখিতভাবে মাথা নাড়লেন, “আমার একার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কতজনকে করতে হবে তা বুঝতে পারছি না। অ্যাম্বুলেন্সে একটা খবর দাও।”
“দিয়েছি। এখন আর কী করব?”
“তুমি ঘাবড়ে গেছ। মাথা ঠাণ্ডা রাখো। ডেল্টার সঙ্গে পাল্লা টানতে আসা তোমার উচিত হয়নি। আমি বলি কি, তুমি বরং ফিরেই যাও। আমার পরিণতি তো বুঝতেই পারছ।”
“পারছি। তবু ব্যাপারটার শেষ দেখতে চাই।”
“একেবারে ড্রপসিন পড়ার পর যাবে? কিন্তু ততক্ষণে যদি তোমার জীবনেও ড্রপসিন নেমে আসে?”
“প্রাণের ভয় আমার ততটা নেই। কিন্তু ভয় পাচ্ছি, আমার অসহায় অবস্থাকে। ডেল্টার সঙ্গে একটু লড়াই হল না, বিনা যুদ্ধে এ তো একেবারে কাপুরুষের মতো মরতে হবেই দেখছি।”
“বীরের মতো লড়লেও লাভ ছিল না। ডেল্টা বীরদেরও ঢিট করতে জানে।”
একটু বাদে অ্যাম্বুলেন্স এল এবং রাম পহলওয়ানের অচেতন দেহটা তুলে নিয়ে চলে গেল। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখলেন বাবু মিত্তির। চোখের কোণে জল টলটল করছিল।
৩. কালীপুরের সবচেয়ে বিখ্যাত জিনিস
কালীপুরের সবচেয়ে বিখ্যাত জিনিস হল তার কালীবাড়ি। বাদা অঞ্চলের এই দুর্গম গাঁয়ে লোকজনের যাতায়াত কম। তবু লোকে ওই কালীবাড়ির টানে কষ্ট সয়েও আসে। শোনা যায় পর্তুগিজ বোম্বেটের আমলে একজন দেশি ডাকাতও খুব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। তার নাম তারাপ্রসাদ। এ-গাঁয়ের প্রতিষ্ঠাতা সে-ই। কালীবাড়িও তার প্রতিষ্ঠা করা। ডাকাত তারাপ্রসাদ গরিবের বন্ধু ছিল, দানধ্যান ছিল প্রচুর। পর্তুগিজ বোম্বেটেদের সঙ্গে লড়াইও সে করেছে এলাকা দখলের জন্য। তখনকার শাপদসঙ্কুল সুন্দরবনে সে অকুতোভয়ে দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়াত নৌকো এবং ছিপে। লোকে বলত, তারাপ্রসাদ পিশাচসিদ্ধ।
তারাপ্রসাদ নেই, তবে তার প্রতিষ্ঠিত গাঁ এবং কালীবাড়ি আছে। আর আছে তার এক বংশধর। কালীপ্রসাদ। তারাপ্রসাদকে লোকে ভয় পেত। কালীপ্রসাদকেও সবাই দারুণ ভয় খায়। তার কারণ কালীপ্রসাদ অতিশয় রহস্যময় পুরুষ। যেমন গম্ভীর তেমনই অমিশুক, কালীপুরের মায়ের মন্দিরের পিছনে কয়েক ফার্লং দূরে কালীপ্রসাদের বিশাল বাগানঘেরা পাকা বাড়ি। সেই বাড়িতে কালীপ্রসাদ ছাড়া আর থাকে একজন রান্নার লোক এবং একজন কাজের লোক। এ-দু’জন কালীপুরের বাসিন্দা নয়, কালী প্রসাদ অন্য জায়গা থেকে এদের আনিয়েছেন। কাজের লোকটি বোবা এবং কালা, পাঁচক ঠাকুরটি অত্যন্ত কম কথার মানুষ। কালীপ্রসাদের সঙ্গে গাঁয়ের লোকের বিশেষ ভাবসাব নেই। তাঁর বাড়িতে কেউ কস্মিনকালে যায় না। পুজোর চাঁদা তুলতে বা বিজয়ার কোলাকুলি করতেও নয়। কারণ কালীপ্রসাদ ওসুব পছন্দ করেন না।
কালীপ্রসাদ সম্পর্কে গাঁয়ে নানা কিংবদন্তি আছে। তার মধ্যে একটা হল, কালীপ্রসাদ ভূত পোষেন। তাঁর পোষা ভূতের সংখ্যা কারও মতে সাত, কারও মতে সতেরো। কালী প্রসাদের বাড়িতে নিশুত রাতে হঠাৎ-হঠাৎ প্রচণ্ড আলোর ঝলকানি দেখা যায়, লাল-নীল ধোঁয়া ওড়ে, বিচিত্র সব শব্দ হয়। অনেকে দেখেছে, অনেকে শুনেছে। কালীপ্রসাদ ভূত পোষেন কি না তা হলফ করে বলা যাবে না, তবে একসময়ে বাঘ পুষতেন। সুন্দরবনের বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল বাঘের একটা বাচ্চা জঙ্গলের কোথাও কুড়িয়ে পেয়ে নিয়ে আসেন। সেটা ধীরে ধীরে বিরাট আকারের কেঁদো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কয়েক বছর আগেও সেটা স্বাধীনভাবে বাড়ির ভেতরে ঘুরে বেড়াত। সেটা মারা গেছে। এখন কালীপ্রসাদ পায়রা পোষেন। তাঁর নানারকমের অনেক পায়রা আছে।
যৌবনকালে কালীপ্রসাদ কলকাতায় থাকতেন। বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। খুবই ভাল ফুটবল খেলতেন। কলেজে তাঁর সহপাঠী ছিলেন বিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা বাবু মিত্তির। দুজনের দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। পরে বাবু মিত্তির বিদেশে চলে যান। কালী প্রসাদের সঙ্গে তারপর থেকে আর যোগাযোগ ছিল না। দীর্ঘদিন বিদেশে কাটিয়ে বাবু মিত্তির ফিরে এসে যখন সংসারী হতে চাইলেন, তখন তাঁর বিয়ের নেমন্তন্ন পেয়ে কালীপ্রসাদ গিয়েছিলেন। দুই বন্ধুতে তখন খুব পুরনো দিনের কথা হয়। তারপর থেকে আবার কালীপ্রসাদ যাওয়া-আসা করতেন, বাবু মিত্তিরও সপরিবারে এসে কয়েকবার কালীপুরে কাটিয়ে গেছেন। চণ্ড রাগ আর দুর্ব্যবহারের জন্য বাবু মিত্তিরকে কেউ পছন্দ করে না বটে, কিন্তু কালীপ্রসাদকে বাবু মিত্তির বরাবরই একটু আলাদা খাতির করেন।
চিরকাল সমান যায় না। বাবু মিত্তির ব্যবসা করে হঠাৎ টি বড়লোক হয়ে গেলেন, ব্যস্ততা বাড়ল। কালীপ্রসাদও আর ঘন-ঘন যেতেন না। মেলামেশাটা কমে গেল। তারপর একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল।