চিঠিটা ফেরত নিয়ে পকেটে ভরে বাবু মিত্তির বললেন, “তুমি চিঠিটার আসল অর্থ জানো না।”
“ডেল্টা কথাটার অর্থ কী?”
“ব-দ্বীপ।”
“সে তো বাচ্চা ছেলেও জানে। কিন্তু এখানে কী অর্থে প্রয়োগ হয়েছে? চিঠিটা দিলই বা কে?”
“সবটা তোমাকে বলা যাবে না। আমার একটা বিশ্রী অতীত আছে। খুব ভয়ঙ্কর সেই অতীত। ডেল্টা একটা আন্তর্জাতিক সংগঠন। আগে ছোট ছিল। এখন বিশাল আকার নিয়েছে।”
গজপতি হঠাৎ চিন্তিত মুখে বললেন, “ডেল্টা! ডেল্টা! দাঁড়াও, বোধ হয় ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে একটা খবর পড়েছি, তাতে এ নামটা যেন ছিল!”
“ঠিকই ধরেছ, টাইম ম্যাগাজিন আমিও পড়ি। কিছুদিন আগে ডেল্টার গুপ্তঘাতকেরা নিউ ইয়র্কে একজনকে দিনে-দুপুরে মারে।”
গজপতি উদ্বেগের সঙ্গে বলেন, “এরাও কি তারাই?”
“তারাই। আমি একসময়ে ওদের মেম্বার ছিলাম। পালিয়ে এসেছিলাম। আজও ওরা প্রতিশোধের কথা ভোলেনি।”
গজপতি অবাক হয়ে বাবুর দিকে চেয়ে বলেন, “কিন্তু সংস্কৃত শ্লোক ওরা কোথায় পেল?”
বাবু মিত্তির মলিন একটু হাসলেন, “গীতা একটি আন্তজাতিক গ্রন্থ। সবাই খোঁজ রাখে। আমি ভারতীয় বলেই ওরা গীতা থেকে লাগসই একটা শ্লোকের কিছুটা তুলে দিয়েছে। অর্থ পরিষ্কার। আমাকে জীর্ণ বাসটি ত্যাগ করতে হবে। অর্থাৎ
“অর্থাৎ মৃত্যু?”
“এবার তোমার মাথা খেলছে।”
“ব্যাপারটা কি সত্যিই সিরিয়াস মিত্তির?”
“আমি ডেল্টাকে যতদূর চিনি, তাতে এই পরোয়ানাকে অমোঘ বলে ধরে নিতে পারো। আমাকে ওরা মারবেই। সেটা কবে বা কখন তার কিছু ঠিক নেই। আমার মনে হয়; ওরা দেরি করবে না। আমি একা মানুষ, অসুস্থ, নিজেকে রক্ষা করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। ওদের কাজটা খুবই সহজ হবে।”
গজপতি একটু ভাবলেন। বাবু মিত্তির ধৈর্য হারিয়ে বললেন, “কী ভাবছ গজপতি? ভাববার সময় কিন্তু নেই।”
গজপতি বললেন, “না ভেবে পরামর্শ দেওয়া যায় নাকি?”
“তা হলে চটপট ভাবো। আমার যে সময় নেই।”
গজপতি ভ্রু কুঁচকে বললেন, “তোমার ওই চিঠিটাকে যদি সিরিয়াস বলে ধরেও নিই তা হলে অনুমান করতে পারি যে, ওরা তোমাকে খুন করতে বিদেশ থেকেই খুনি পাঠাবে। তাতে তো একটু সময় লাগার কথা। বিদেশ থেকে যে খুনটা করতে আসবে তাকে তো আগে এ-দেশের ঘাঁতঘোঁত জানতে হবে, নিজেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করে তবেই তো সে খুনটা করবে, নাকি?”
বাবু মিত্তির মাথা নেড়ে বললেন, “তা নয়। আগে এ-দেশে ওদের অর্গানাইজেশন ছিল না। আজকাল হয়েছে।”
“কী করে বুঝলে?”
“খুব সোজা। যেসব দেশে বহু ছেলে-ছোঁকরা বেকার বসে থাকে, যাদের ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই তারা রুজি-রোজগারের ধান্দায় যে-কোনও কাজে নামতে রাজি হয়ে যায়। আমি যখন ডেল্টায় ছিলাম তখন দেখেছি, অনুন্নত এবং গরিব দেশগুলোয় কত তাড়াতাড়ি অগানাইজেশনকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। আজকাল অপরাধও একটা ভাল জীবিকা।”
“তা হলে তুমি বলতে চাও ওরা এ-দেশেরই কাউকে এ কাজে লাগাবে?”
“সেটাই স্বাভাবিক।”
“তুমি কি জানো যে, ভারতবর্ষে ওদের অর্গানাইজেশন আছে?”
বাবু মিত্তির ম্লান হেসে বললেন, “তুমি ব্যস্ত উকিল, তাই বেশি খবর রাখো না। আমি কিন্তু বেকার মানুষ, হাতে অঢেল সময় বলে প্রচুর দেশি-বিদেশি ম্যাগাজিন পড়ি। ডেল্টা গত দু বছরে দিল্লি, বোম্বাই আর কলকাতায় ছড়িয়ে পড়েছে।”
এবার গজপতি খুবই উদ্বিগ্ন মুখে বাবুর দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “তা হলে আপাতত তুমি বাড়িটা ছেড়ে কিছুদিন গা-ঢাকা দাও।”
বাবু মিত্তির মাথা নেড়ে বললেন, “লাভ নেই। ওদের যতদূর জানি এ চিঠি দেওয়ার আগে থেকেই ওরা আমাকে স্পট করেছে এবং নজরে রেখেছে। এই যে আমি তোমার কাছে এসেছি, ফেরার পথে হয়তো একটা মস্ত ট্রাক আমাকে গাড়িসমেত পিষে দিয়ে যাবে। কিংবা ডেল্টার লোক হয়তো আমার বাড়িতে কোনও অছিলায় ঢুকে আমার জলের কুঁজোয় সায়ানাইড মিশিয়ে দিয়ে যাবে। ইট উইল নট বি এ হিরোইক ডেথ ফর মি।”
গজপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “গুলিটুলি করবে না বলছ?”
“গুলিতে শব্দ হয়। খুনের প্রমাণ থাকে। ডেল্টা অত কাঁচা কাজ করে না। আজকাল তারা খুব স্কিলফুল কিলার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাফিয়াদেরও পিছনে ফেলে দিচ্ছে। শোনো, আমার মৃত্যু নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না। ওটা ঘটবেই। আমি শুধু বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে তোমার পরামর্শ চাই।”
গজপতি বিষণ্ণ মুখে বলেন, “বিষয়-সম্পত্তির বিলিব্যবস্থা করতেও তো একটু সময় চাই। তুমি যা বলছ, তাতে তো সময় একদম নেই। আচ্ছা, একটা কাজ করলে কেমন হয়?”
“কী কাজ?”
“কিছুদিনের জন্য যদি একজন বডিগার্ড রাখো?”
“কী লাভ? আমি যাকে বডিগার্ড রাখব তাকেও বিপদে ফেলে দেওয়া হবে। বাধা দিলে খুনি কি তাকেও ছাড়বে ভাবছ?”
“বডিগার্ডদের তো সেই ঝুঁকি নিতেই হবে। নইলে আর বডিগার্ড কিসের?”
“আমি কাউকে বিপন্ন করতে চাই না। বডিগার্ডের সাধ্যও নেই ডেল্টার খুনির হাত থেকে আমাকে রক্ষা করবে।”
গজপতি হতাশ গলায় বলেন, “তুমি চিরকালের গোঁয়ারগোবিন্দ, সবাই জানে। কিন্তু একটা কথা বুঝবার চেষ্টা করো। যদি ডেল্টার হুমকিটা সত্যিকারের হয় তা হলেও তোমার বিষয়-সম্পত্তির বিলিব্যবস্থার জন্য কিছু সময় দরকার। বডিগার্ড রাখলে হয়তো তোমার খুনি চট করে এগোবে না, একটু ভাববে। এবং নতুন ফন্দি আঁটবে। সেই ফাঁকে তুমি কিছু সময় পেয়েও যেতে পারো। আর একটা কথা হল, সবসময়েই এক জোড়ার চেয়ে দু জোড়া চোখ ভাল। তোমার গার্ড যদি একজন ইয়ংম্যান হয় তা হলে তার রিফ্লেক্স বা রি-অ্যাকশন তোমার চেয়েও অনেক বেশি ভাল হবে।”