লম্বা সুরুঙ্গে চেহারার একটা লোক ভিতরে এসে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে ঠাণ্ডা গলায় ইংরেজিতে বলল, “ওদের বেঁধে ফেল।”
চটপট বাঁধা হল চারজনের হাত আর পা। লম্বা লোকটা বলল, “চোখেমুখে জল দাও। জ্ঞান ফিরে আসুক।” তাই করা হল। বাবু মিত্তির একটু কাতর শব্দ করে উঠে বসলেন। তারপর সামনে চেয়ে লম্বা লোকটাকে দেখে ভীষণ চমকে উঠে বললেন, “পল!”
“চিনতে পারছ তা হলে? বিশ্বাসঘাতক!” বাবু মিত্তির ডুকরে উঠে বললেন, “বিশ্বাস করো পল, আমি রাউলকে মারিনি। রাউল আমার বন্ধু ছিল। রাউলকে মেরেছিল সিকিউরিটির লোরো।”
“তোমার সাফাই আমার জানা ছিল। পুত্রশোক কিরকম হয় তা জানো? এত বছর ধরে আমি ভিতরে-ভিতরে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছি। তোমাকে সেই জ্বালার একটু ভাগ দিতে চাই।”
“দোহাই পল, একাজ কোরো না। কী প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে বলল। ডলার ফেরত চাও, দেব। সব কিছু করব। শুধু আমার ছেলেটাকে ছেড়ে দাও।”
“রাউল তোমার বন্ধু ছিল, তোমার জন্য সে অনেক কিছু করেছিল। প্রতিদানে তার জুটেছিল কয়েকটা বুলেট। এ-পাপের কী প্রায়শ্চিত্ত হয়। আর যদি হয় তা ঠিক এইভাবেই হয়। পুত্রশোকের ভাগিদার হয়ে সেই প্রায়শ্চিত্তই করতে হবে তোমাকে। তারপর ধীরে ধীরে অশেষ যন্ত্রণা পেয়ে ক্যানসারে মারা যাবে তুমি। আমি এ-দিনটারই অপেক্ষায় ছিলাম।”
বাবু নিজেকে সংযত করলেন। গলা থেকে আবেদন-নিবেদনের ভাবটা মরে গেল। তেজী গলায় বললেন, “পল, আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে বলছ? তোমার পাপও কি কিছু কম? অলিম্পিকে সোনার পদক আমার বাঁধা ছিল। কেউ সেবার আমাকে হারাতে পারত না। তুমি রাউলকে পদক পাইয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে ফুড পয়জ করেছিলে। বলো, করোনি? তুমি কি জানো একটা অলিম্পিকে একটা সোনার পদক আমার কাছে তখন কতখানি মূল্যবান ছিল?”
পল হাসল, “পদকের শোকের চেয়েও বড় শোক পৃথিবীতে আছে। স্বীকার করছি, আমি তোমাকে রাউলের পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ক্ষতিপূরণও করেছি। তোমাকে অনেক টাকা দিয়েছি।”
“এমনই দাওনি। আমাকে পাপের পঙ্কিল পথে নামিয়েছিলে।”
“দুনিয়াতে পাপ বলে কিছু নেই। ওসব দূর্বলদের কথা। যে-কোনও জীবিকাই জীবিকামাত্র।”
“তুমি পিশাচ।”
“ঠিক কথা। এখন বলো তো, তোমার ছেলের মৃত্যু আমি কীভাবে ঘটাব! পারবে বলতে?”
“আগে আমাকে মারো পল। এইটুকু দয়া করো।”
পল হাসল। বলল, “ধীরে বন্ধু, ধীরে। তাড়াহুড়োর কী আছে? দুনিয়াটাকে আর কিছুদিন ভোগ করে নাও। আমার খুব ইচ্ছে, তোমার ছেলের ডান হাতটা প্রথমে কেটে ফেলি। ও চেঁচাবে, ছটফট করবে। তুমি চেয়ে-চেয়ে দেখবে। কেমন হবে ব্যাপারটা?”
রকি একটা ঝাঁকি দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বলল, “আমি তোমাকে একটা কথা বলে নিতে চাই পল। আমি মরতে ভয় পাই না। বেশি নাটক না করে যা করার করে যাও।”
“অত তাড়া কিসের? গাড়ি ধরবে নাকি?” বলে পল খুব হাসল। হঠাৎ তার হাতে ঝিকিয়ে উঠল একটা এক ফুট লম্বা সরু ছুরি।
কালীপ্রসাদের হাত-পা নিসপিস করছিল। তিনি মুঠো বাগিয়ে এক পা এগিয়ে গিয়েছিলেন। কানের মধ্যে মশা পনপন করে উঠল, “করো কী! চুপ করে থাকে। নাটকটা দেখতে দাও।”
প্রায় নিঃশব্দে কালীপ্রসাদ হাসলেন,”যে আজ্ঞে।”
ছুরিটা হাতে নাচাতে-নাচাতে পল বলল, “চেয়ে দ্যাখো বাবু। দু চোখ ভরে দ্যাখো, প্রথমে তোমার ছেলের ডান হাত কেটে নিচ্ছি। তারপর বাঁ হাত। তারপর একটা চোখ উপড়ে নেব। তারপর আর-একটা। তখনও ও মরবে না। চেঁচাবে, দাপাবে। ঘণ্টাখানেক বাদে রক্তক্ষরণে মারা যাবে। দ্যাখো। “
বলে পল গিয়ে রকির সামনে দাঁড়াল।
ঠিক এই সময়ে কালীপ্রসাদ পিস্তলটা তুলতে যাচ্ছিলেন। আর সময় নেই। কিছু একটা না করলে রকি মরবে।
মশাটা কানে পনপন করে উঠে বলল, “ওকাজ কোরো না। তুমি আমাদের শেষ বংশধর। খুনটুন করে বসলে পাপ হয়ে যাবে। তা হলে নিম্নগতি হবে। আমাদের উদ্ধার করবে কে?”
“যে আজ্ঞে।”
ভক করে হঠাৎ বোঁটকা গন্ধটা নাকে এল কালী প্রসাদের। খুবই চেনা গন্ধ। গতকালও পেয়েছিলেন। গন্ধের উৎস খুব কাছেই। কালীপ্রসাদ চারদিকে তাকাতে লাগলেন। হঠাৎ চমকে উঠে দেখলেন, ঠিক তাঁর পাশে, গা ঘেঁষেই বিশাল কেঁদো বাঘটা।
পল ছুরিটা নিপুণ হাতে ধরে রকির কনুইয়ের ওপর চালাতে যাচ্ছে ঠিক এই সময়ে তার দলের লোকেরা আর্তনাদ করে উঠল, “বাঘ! বাঘ!”
পল চকিতে ঘুরে দাঁড়াল, “মাই গড! শুট ইট।”
সঙ্গে-সঙ্গে গোটা-দুই স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ট্যারা-ট্যাট-ট্যাট করে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছিল বাঘটাকে।
কিন্তু বাঘটা নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে পথের দিকে চেয়ে ছিল। পল ছুরিটা তুলে বিদ্যুৎগতিতে ছুঁড়ল বাঘটার দিকে। কালীপ্রসাদ অবাক হয়ে দেখলেন ছুরিটা বাঘটাকে ভেদ করে দেওয়ালে গিয়ে লাগল।
তারপর যা ঘটল তা অবিশ্বাস্য। বাঘটা একটা চাপা গর্জন করে একটা ঘূর্ণিঝড়ের মতো গিয়ে পড়ল পলের ওপর। তাকে মুখে তুলে নিয়ে একটি লাফে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে পড়ল।
পলের স্যাঙাতরা ছিটকে পড়ল এদিক-ওদিক। সবাই কুমড়ো-গড়াগড়ি।
মশাটা কালীপ্রসাদের কানের মধ্যে বলল, “ওদের বাঁধন খুলে দাও। পাজি লোকগুলোকে বেঁধে ফেল। ওরা এখন নিরস্ত্র।”
কালী প্রসাদ বললেন, “যে আজ্ঞে। কিন্তু বাঘটা কোথা থেকে এল?”
“ওকে চিনতে পারলে না? ও তোমার হালুম।”