কালীপ্রসাদ স্থির হয়ে মশার শব্দটা মন দিয়ে শুনতে লাগলেন। মশাটা গুনগুন করে বলল, “নিজেকে খুব বুদ্ধিমান ভাবো নাকি?”
“আজ্ঞে না।”
খুব বিনীতভাবে বললেন কালী প্রসাদ।
“তোমার শত্রুপক্ষ খুবই শক্তিমান। ইচ্ছে করলেই তারা তোমাদের সুন্ধু গোটা বাড়িটাই উড়িয়ে দিতে পারে।”
“যে আজ্ঞে।”
“তোমাদের কাছে যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র নেই, লোকবল নেই, প্রবল শত্রুর সঙ্গে পারবে কী করে?”
“আমাকে পরামর্শ দিন।”
“তুমি যে বন্ধু এবং আশ্রিতজনদের বাঁচানোর জন্য নিজের বিপদ তুচ্ছ জ্ঞান করছ এতে আমরা–তোমার পূর্বপুরুষেরা সন্তুষ্ট। শত্রুদের লক্ষ্য দু’জন। বাবু মিত্তির আর তার ছেলে। ছেলেটাকে মারতেই তারা এসেছে। বাবু মিত্তিরকে তারা মারবে না, দগ্ধে-দগ্ধে মরতে দেবে বুঝেছ?”
“যে আজ্ঞে। “
“সুতরাং সকলের মঙ্গলের জন্য তোমার উচিত হবে ছেলেটাকে শত্রুপক্ষের হাতে ছেড়ে দেওয়া।”
কালী প্রসাদ শিহরিত হয়ে বললেন, “সে কী! তা হলে তো চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।”
মশা যে হাসতে পারে তা জানা ছিল না কালীপ্রসাদের। শুধু হাসি নয়, অট্টহাসি। কালীপ্রসাদ নিজের কানের মধ্যে সেই আশ্চর্য অট্টহাসি শুনতে পেলেন। মশা বলল, “শোনো কালীপ্রসাদ, নিজের বুদ্ধিতে যদি চলো তা হলে আমার পরামর্শের প্রয়োজন তোমার নেই। সেক্ষেত্রে তোমাদের ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।”
“আজ্ঞে, আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন।”
“শত্রুপক্ষের সর্দারের নাম পল। সে নিজে এসেছে। ঢ্যাঙা এবং শীর্ণ চেহারার একটি লোক। সে অত্যন্ত প্রতিহিংসাপরায়ণ। বহুদিন ধরে সে প্রতিশোধের জন্য অপেক্ষা করছে। আজ সে নিজের হাতে বাবু মিত্তিরের ছেলেকে মারবে। নইলে তার বুকের জ্বালা জুড়োবে না।”
কালীপ্রসাদ অবাক হয়ে বললেন, “পল নিজে এসেছে?”
“হ্যাঁ। তুমি সদর দরজাটা খুলে দাও। ওদের আসতে দাও। তার আগে বাবু মিত্তিরের কাছে গিয়ে তার পিস্তলটা চেয়ে নাও কারণ সে গুলি ছুঁড়লে সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে।”
এ কাজ করলে বাবু যে আমাকে আর বিশ্বাস করবে না। আমি বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে পড়ে যাব।”
“তা হলে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা অনুযায়ী চলো। আমাদের আর কিছু করার নেই।”
কালীপ্রসাদ তাড়াতাড়ি বললেন, “আজ্ঞে, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনার পরামর্শই মেনে নিচ্ছি।”
“তা হলে তাড়াতাড়ি করো। সদর দরজাটা অত্যন্ত দুর্লভ কাঠ দিয়ে তৈরি। ও কাঠ আর পাওয়া যায় না। শত্রুরা দরজাটা ভাঙার আগেই ওটা খুলে দিতে হবে। বুঝেছ?”
“যে আজ্ঞে।”
কালীপ্রসাদ বিষণ্ণ মনে ধীরে ধীরে দোতলায় উঠে বাবু মিত্তিরের ঘরে এলেন।
“বাবু।”
বাবু মিত্তির জানালার ধারে পিস্তল হাতে নিয়ে বসে ছিলেন। ডাক শুনে চমকে ফিরে তাকালেন, “কী রে?”
“তোর পিস্তলটা আমাকে দে।”
“কেন?”
“দে না।”
বাবু মিত্তির সন্দিহান চোখে বন্ধুর দিকে কয়েক পলক চেয়ে রইলেন অন্ধকারে। তারপর দ্বিধাজড়িত হতে পিস্তলটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “কিছু দেখেছিস?”
কালীপ্রসাদ সত্যি কথাটাই বলবার জন্য হাঁ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর হয়ে আর-একটি কণ্ঠ বলে উঠল, “না, কিছু দেখিনি। তুই দেখেছিস?”
বাবু বললেন, “না। কিন্তু পাখির ডাক শুনছি। রাতে পাখি ডাকে নাকি?”
অন্য কণ্ঠটি কালীপ্রসাদের হয়ে বলল, “তা ডাকে। ভয়ের কিছু নেই। এখনও।”
“পিস্তলটা নিচ্ছিস কেন?”
অন্য কণ্ঠটি বলল, “তোর ভালর জন্যই। এখন তোর মাথা ভাল কাজ করছে না। দুম করে চালিয়ে দিলে বিপদ হতে পারে।”
“তা বটে। বুড়ো বয়সে খুনটুন করার ইচ্ছেও আমার ছিল না। কিন্তু ছেলেটাকে বাঁচাতে তো কিছু করতেই হবে।”
অন্য কণ্ঠটি বলে উঠল, “বিপদে মাথা ঠিক রাখতে হয়।”
কালীপ্রসাদ চমৎকৃত হচ্ছিলেন। হুবহু তাঁর গলা নকল করে কে কথাগুলো বলে দিচ্ছে? তিনি কণ্টকিত শরীরে নীচে এলেন। তারপর সাবধানে সদর দরজার খিল খুলে দরজাটা হাট করে দিলেন। তারপর ল্যাবরেটরিতে এসে জানালার কাছে বসে রইলেন।
প্রথমে অনেকক্ষণ কিছুই ঘটল না। বাগানে নড়াচড়া নেই। কানেও মশার শব্দ নেই। কালীপ্রসাদ শুধু চেয়ে রইলেন।
হঠাৎ ওপর থেকে বাবু মিত্তিরের চিৎকার শোনা গেল, “সাবধান! ওরা আসছে!”
বাবু বোধ হয় দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দৃড়দাড় নামতে লাগল। কালীপ্রসাদ আরও তিনজোড়া পায়ের শব্দ পেলেন। সবাই ছুটে আসছে নীচে।
কানে মশাটা বলে উঠল, “হুঁড়োহুড়ি কোরো না। যা ঘটছে ঘটতে দাও।”
কালীপ্রসাদ বললেন, “যে আজ্ঞে।”
বলে উঠে দরজায় এসে দাঁড়ালেন। সামনেই দরদালান। ডান দিকে সদর দরজা। দেখলেন সদর দরজা দিয়ে কয়েকটা ছায়ামূর্তি চটপটে পায়ে ভিতরে ঢুকে সিঁড়িটা আগলে দাঁড়াল।
বাবু সবার আগে নেমে আসছিলেন। অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা তাঁর লোপ পেয়েছে। তিনি চার সিঁড়ি ওপর থেকে ঘুসি বাগিয়ে লোকগুলোর ওপর লাফিয়ে পড়লেন, “তবে রে! আজ সবাইকে শেষ করে ছাড়ব।”
শুধু বাবু নয়, পিছনে রকি, পলাশ, যোগেন। বাবু আর রকি দক্ষ বক্সার। তারা দুমদাম খুঁসি চালিয়ে যেতে লাগল। ছায়ামূর্তিরা একটু বেসামাল হয়ে পড়ল আচমকা আক্রমণে। দু’জন, ঘুসি খেয়ে পড়েও গেল ছিটকে। কিন্তু তারপরেই লোকগুলো ছোট-ছোট ব্যাটনের মতো জিনিস দিয়ে পালটা মারল।
মিনিটখানেকের মধ্যেই লড়াই শেষ হয়ে গেল। সিঁড়িতে আর দরদালানের মেঝেয় চারজনই ভূমিশয্যা নিয়েছে।