“না। অনেকবার বলেছেন।”
“কালীপ্রসাদ তার কাছে যেতে লিখেছে। গেলে হয়তো রকির সঙ্গে আমার দেখাও হবে। কিন্তু যাওয়া কি উচিত?”
“খুবই উচিত। কারণ রকির চিঠি ডেল্টাও পড়েছে। তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। রকি যে কালীপ্রসাদের কাছেই যাবে এটা বুঝতে তাদের দেরি হবে না।”
“সর্বনাশ! তা হলে তো আমার এখনই সেখানে যাওয়া উচিত!”
পলাশ একটু হেসে বলল, “যাওয়া উচিত তো ঠিকই। কিন্তু আপনি এখন আর সেই আগেকার অলিম্পিক বক্সার নেই। গায়ের জোরে রকিকে বাঁচাতেও পারবেন না। আর আমার মনে হয় কালীপ্রসাদ অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক। যদি পারেন তা হলে তিনিই হয়তো পারবেন রকিকে বাঁচাতে।”
একটু দোনোমোনো করে বাবু মিত্তির বললেন, “তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে?”
“আপনি কি আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেন?”
বাবু মিত্তির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বিশ্বাস না করেও কোনও লাভ নেই। তুমি যদি ডেল্টার লোকও হয়ে থাকো তবু তুমি তো সবই জানো।”
“এবার ঠিক কথাই বলেছেন। আপনি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিন। কালীপুরে যেতে হলে তাড়াতাড়ি রওনা হওয়া ভাল। আপনার
অনুপস্থিতিতে রাখাল বাড়ি আগলে থাকতে পারবে।”
ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় লাগল না। বাবু মিত্তির পলাশকে নিয়ে কালীপুর রওনা হয়ে গেলেন। প্রকাশ্যে বেরিয়ে পড়তে আর কোনও চিন্তা ছিল না বাবু মিত্তিরের। প্রথমত, তেজস্ক্রিয় শলাকা বিছানায় রেখে ডেল্টা ধরেই নিয়েছে যে, অচিরেই বাবুর ক্যানসার হবে। ডেল্টা তিল তিল করে মারতে চাইছে। ফন্দিটা যে খাটেনি তা ডেল্টা এখনও জানে না। বাবু বিছানা পরিপাটি করে পেতে চাঁদরের নীচে অবিকল আর-একটা ছুঁচ রেখে এসেছেন। ডেল্টা সরেজমিনে তদন্তে এলেও ক্ষতি নেই, যদি না তারা তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষার জন্য গাইগার কাউন্টার যন্ত্র আনে। দ্বিতীয়ত, আপাতত তারা বাবুকে না মেরে প্রথমে মারতে চাইবে রকিকে। সুতরাং বাবুর এখন ভয় নেই। ৬৮
পথে কোনও ঘটনাই ঘটল না, শুধু একজন বুড়ো বাউল কামরায় সবাইকে ছেড়ে বাবু মিত্তিরের সামনে এসে একটু নেচে নেচে যখন গাইছিল, “পিঁজরার পাখি রে ডাকিছে গগন, ছাড়িয়া দাও তারে এইবারে …” তখন বাবু মিত্তির চাপা গলায় বলে উঠলেন, “ডেল্টা!”
পলাশ বলল, “ডেল্টা কি এভাবে নিজেকে এক্সপোজ করবে?”
“তা বটে।” বাউলটা মাঝপথে নেমে গেল। বাকি পথটায় আর কোনও ঘটনা ঘটল না। যখন কালীপুরের ঘাটে এসে নামলেন তখন বিকেল হয়-হয়। প্রায় এক যুগ পরে রকির সঙ্গে দেখা হবে ভেবে বাবু মিত্তিরের বুকটা আনন্দে এত ধড়ফড় করছিল যে, ভাল করে শ্বাস নিতে পারছিলেন না। শরীরটা যেন বেহাল। আবার মনে হচ্ছে, রকির এখানে থাকা কি সম্ভবপর? এতই সহজ হবে কি ব্যাপারটা?
সুন্দরবনে গাড়িঘোড়া, রিকশা কিছুই নেই। নৌকো আর হাঁটাপথ। কিছু-কিছু জায়গায় রিকশা-ভ্যান চলে। কালীপুরে তাও নেই। অনেকটা হাঁটতে হল। কিন্তু হাঁটাটা বাবু মিত্তিরের পক্ষে মঙ্গলজনকই হল। বুকের ধড়ফড়ানি কমে গিয়ে স্বাভাবিক বোধ করতে লাগলেন।
কালীপ্রসাদের বাড়ির ফটকে ঢুকতে যেতেই কোথা থেকে একটা মুশকো লোক ইয়া বড় এক মুগুর হাতে সামনে উদয় হল। চোখে কটমটে দৃষ্টি। ঢুকতে দেবে না। বাবু মিত্তির খুঁসি বাগিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু পলাশ বাধা দিয়ে বলল, “এ তো কালীপ্রসাদেরই লোক হতে পারে। দাঁড়ান দেখছি কথা বলে।”
কিন্তু বিপদ হল, লোকটা বোবা। কথা বলতে পারে না, কিন্তু কটমটে চোখ দুটোই ওর কথা। বলতে চাইছে, কেটে পড়ো।
বাবু মিত্তির একটু রাগের গলায় বললেন, “ওহে পলাশ, চৌকাঠই যে ডিঙোতে পারছি না। আমি বরং একে আস্তে করে একটা আপারকাট মেরে দিই, নইলে ঢুকতে দেবে না।”
পলাশ বাধা দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু বাবু মিত্তিরের তর সইল না। রকির সঙ্গে দেখা হবে, তিনি কাঁহাতক ধৈর্য রাখতে পারেন। তিনি সোজা এগিয়ে গিয়ে তাঁর বহু-বিখ্যাত খুঁসির একটি চালিয়ে দিলেন।
আশ্চর্যের বিষয়, এখনও বাবু মিত্তিরের খুঁসির বহর দেখবার মতো। বিরাট চেহারার লোকটা ঘুসি খেয়ে প্রায় শূন্যে উঠে ছিটকে পড়ল মাটিতে। বাবু মিত্তির হাত দুটো নেড়ে বললেন, “দেখলে?”
“দেখলাম!” কথাটা যে বলল সে পলাশ নয়। অন্য একজন। ফটকের পাশ থেকে ছিপছিপে চেহারার একটি দীর্ঘকায় যুবক বেরিয়ে এল সর্পিল গতিতে। কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই সে সামনে পলাশের চোয়ালে একটা বিদ্যুৎগতির ঘুসি মারল। পলাশ ধানুর মতোই খানিকটা শূন্যে বিচরণ করে ছিটকে পড়ে গেল এবং পড়েই রইল। ছোঁকরার দ্বিতীয় খুঁসিটা অবশ্যম্ভাবী বাবু মিত্তিরের মাথা লক্ষ্য করে সাপের ছোবলের মতোই এল। বাবু মিত্তির অভ্যস্ত সাইড স্টেপ করে সরে গিয়েই বাঁ হাতে বিষাক্ত একখানা জ্যাব করলেন। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, ডেল্টা তার জন্য এখানেই অপেক্ষা করছিল। ডেল্টার ওপর তার সুগভীর রাগ। সামনে যাকে পান তাকেই খুন করেন। এটাও বুঝতে পারছেন, পুরো ব্যাপারটাই একটা চক্রান্ত। রকির চিঠি, পলাশের ব্যাখ্যা, এখানে তাঁকে নিয়ে আসা, সবই যেন চক্রান্তের একটা অংশ।
তাঁর জ্যাবটা ছেলেটা হাতেই ব্লক করে দিল। তারপর ডান হাতে চমৎকার একটা নক-আউট পাঞ্চ করল বাবুর চোয়ালে। কিন্তু বাবু মুখটা সরিয়ে ঘুসিটাকে বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে ব্যাক স্টেপ করে সরে এলেন। বহুকাল পরে উপযুক্ত প্রতিপক্ষ পেয়েই যেন বাবু মিত্তিরের রক্ত টগবগ করে ফুটতে লাগল। শিরায়-শিরায় গরম রক্ত পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। বাবু মিত্তির তার প্রতিপক্ষের বয়স ও ক্ষিপ্রতাকে উপেক্ষা করেই দ্রুত দুই পা এগিয়ে ডান হাতে একটা ভূয়ো ঘুসি মেরে ছেলেটার ভারসাম্যে গোলমাল ঘটিয়ে বাঁ হাতে আসল খুঁসিটা মারলেন। কিন্তু ছেলেটা ভালই শিখেছে। দু হাতে ব্লক করে খুঁসিটা আটকে দিয়ে মাথাটা নিচু করে বাঁ হাতটা উঁচুতে তুলে চমৎকার পায়ের কাজ দেখিয়ে এগিয়ে এসে পর-পর অতি দ্রুত তিনটে ঘুসি মারল বাবুকে। বাবু মনে-মনে তারিফ করলেন আর তিনটে মোচড়ে শরীরকে তিনদিকে তিনবারে হেলিয়ে ঘুসিগুলোকে কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলেন, ছেলেটার বাঁ হাতটা সাপের ছোবলের মতো উঁচু করে রাখাটা অবিকল তাঁরই মতো। আর সেইজন্যই তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল কোব্রা। তাঁরও বাঁ হাত সামান্য ওপরে ভোলা থাকত আর সেটা গোখরোর ফণার মতো দোল খেত।