“ছিল একটা ছেলে। কিন্তু মেক্সিকো না কোথায় যেন পলেরই বিশ্বস্ত এক অনুচর তাকে এক পার্টির মধ্যে খুন করে পালিয়ে যায়।”
অনুচরটি কে, তা কালীপ্রসাদ জানেন। কিন্তু রকি বোধ হয় জানে না। কাগজে অত কথা নিশ্চয়ই লেখেনি। ভয় আর প্রশ্ন না করে কালীপ্রসাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, “বাড়ি চল।”
রকি আনমনে নদীর দিকে চেয়ে ছিল। হঠাৎ সচকিত হয়ে বলল, “দাঁড়ান! একটা নৌকো বা ভটভটি আসছে। এটাকে একটু দেখে নিই।”
রকি দক্ষ হাতে-পায়ে পাণ্ডুরাজার ঢিবির ওপর চোখের পলকে উঠে গিয়ে ঝোঁপঝাড়ে অদৃশ্য হল। কালী প্রসাদ একটু আড়ালে সরে দাঁড়ালেন।
একটু বাদে রকির চাপা স্বর পাওয়া গেল, “কালীকাকা, ভটভটি করে পনেরো-বিশজন লোক আসছে। সঙ্গে মুভি ক্যামেরা এবং আরও সব সরঞ্জাম। মনে হচ্ছে সিনেমার শুটিং করতে আসছে। উঠে আসুন না, দেখবেন।”
কালীপ্রসাদ একটু কষ্ট করেই খাড়া ঢিবিটার ওপর উঠে এলেন। রকি বাইনোকুলারটা এগিয়ে দিল। খুবই শক্তিশালী আধুনিক জিনিস। অন্তত মাইলটাক উজানে ভটভটিটাকে দেখা গেল। সত্যিই অনেক লোক এবং সরঞ্জাম। কালীপ্রসাদ অস্ফুট স্বরে বললেন, “মনে হচ্ছে এরাই। শুটিং নয় রে বাবা, ওটা ওদের মুখোশ।”
কালীপ্রসাদ তাড়াতাড়ি নেমে এসে বুড়ো নিতাই মাঝির ঝোঁপড়ার দজ্জায় গিয়ে দাঁড়ালেন।
“মাঝি, আছ নাকি?”
“আছি কর্তা। বলুন।”
“সিনেমাওলাদের আসার কথা আছে নাকি এ-গাঁয়ে?”
“আজ্ঞে না।”
“একটা ভটভটি আসছে। তাতে মেলা লোক। কোথায় আসছে বলতে পারো?”
“কত তোক তো কত দিকে যায়।”
ভটভটিটার জন্য কালীপ্রসাদ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন গা-ঢাকা দিয়ে। কিন্তু শেষ অবধি এল না।
রকি নেমে এসে বলল, “ওরা এর আগে আর-একটা খালে বাঁ দিকে। ঢুকে গেল।”
রকিকে নিয়ে কালীপ্রসাদ বাড়ি ফিরে এলেন। পুরনো বন্দুকটা বের করে সারা সকাল সেটাকে সাফ করলেন। ভারী ছ্যাঁচা ইস্পাতে তৈরি। আজও চমৎকার কণ্ডিশনে আছে। গুলিগুলোও বহু পুরনো। রং চটে বিবর্ণ হয়ে গেছে। মোট পঞ্চাশটার মতো কার্টরিজ রোদে দিয়ে দিলেন। ড্যাম্প ভাবটা চলে যাবে।
রকি কাণ্ড দেখে হেসে বলল, “কাকা, এ বন্দুক তুলে তাক করতে করতে ওরা অটোম্যাটিক রাইফেলে ঝাঁঝরা করে দেবে। আমাদের।”
৬. দুটি রাত প্রায় বিনিদ্র
দুটি রাত প্রায় বিনিদ্র কেটেছে বাবু মিত্তিরের। ছেলের খবর যাওবা পেলেন, কপালের দোষে সেই ছেলেও পড়ে গেল ডেল্টার খপ্পরে। বারবার ট্রাঙ্ককল করছেন আমেদাবাদে। রকির অফিস থেকে জানাচ্ছে, তারা কোনও খবর জানে না। রকি কিছু না জানিয়েই নিরুদ্দেশ হয়েছে। এর অর্থ একটাই হতে পারে। রকি এখন ডেল্টার খপ্পরে। হয় মেরে ফেলেছে, না হলে গুম করেছে। হয়তো মুক্তিপণ হিসেবে ডলার ফেরত চাইবে। ডলার ফেরত দিলেও শেষ অবধি যে রকিকে তারা জ্যান্ত ছাড়বে না তা বাবুর চেয়ে ভাল আর কে জানে!
পরশুই তিনি আমেদাবাদ রওনা হতে চেয়েছিলেন। পলাশ বাধা দিয়ে বলেছে, “ওটা আপনার অচেনা শহর, কোথায় খুঁজবেন তাকে? তা ছাড়া কিডন্যাপ করলেও তারা নিশ্চয়ই আটঘাট বেঁধেই করেছে। আপনি শুধু-শুধু হয়রান হবেন কেন? বরং মাথা ঠাণ্ডা রেখে চিন্তা করুন।”
আজ সকালে আমেদাবাদে আবার টেলিফোন করে একটা সুখবর পেলেন বাবু মিত্তির। রকি নাকি তার অফিসের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছিল কাল। কোথায় আছে বা গেছে তা বলেনি। শুধু বলেছে, সে কিছুদিন ছুটি চায়। এটা সুখবর বটে, কিন্তু দুশ্চিন্তাও আছে। রকি যদি কলকাতায় তাঁর কাছেই আসবার জন্য রওনা হয়ে থাকে তা হলে কী হবে? আজ সকাল থেকে এই দুশ্চিন্তায় তাঁর বুক কাঁপছে, গলা শুকিয়ে আসছে। মড়ার মতো পড়ে আছেন বসবার ঘরের ইজিচেয়ারে।
পলাশ ঘরে ঢুকে তাঁর হাতে এক টুকরো কাগজ দিয়ে বলল, “কাকাবাবু, আপনার পায়রা এসেছে।”
বাবু মিত্তির চমকে উঠে বললেন, “পায়রা! তুমি পায়রার কথা জানলে কীভাবে?”
পলাশ ম্লান একটু হেসে বলে, “আপনি আমাকে যে পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না তা আমি জানি। আপনার মতো অবস্থায় আমিও করতাম না। তবে আমি তো চারদিকে নজর রাখি। তাই পায়রার কথা জানতে অসুবিধে হয়নি।”
বাবু মিত্তির চিরকুটটা পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “কালী আমাকে বাঁচাতে চাইছে। কিন্তু আমার মৃত্যুটা আমার কাছে গৌণ হয়ে গেছে। আমার ছেলেটাকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে পারি তবে সেটাই হবে আমার বেঁচে থাকা। এখন ভয় হচ্ছে, রকি না আমার কাছে চলে আসে!”
পলাশ ভ্রূ কুঁচকে বলে, “রকি আপনার কাছে আসবে বলে আমার মনে হয় না। ডেল্টার বিপদ সম্পর্কে কেউ তাকে অ্যালার্ট করেছে। আর সেজন্যই সে একচুলের জন্য বেঁচে গেছে। রকি পালিয়েছে।”
“কী করে বুঝলে?”
“না পালালে সে গতকাল অফিসে ফোন করত না। আর আগে থেকে খবর না পেলে সে পালাতও না। আপনার মাথা এখন ভালভাবে কাজ করছে না। করলে এই সহজ ইকুয়েশনটা আপনিই কষতে পারতেন।“
“রকি তা হলে কোথায় যেতে পারে?”
“রকির চিঠিটা ভাল করে আবার পড়ন, তা হলেই বুঝতে পারবেন।”
“তুমি বুঝতে পেরেছ?”
“বোধ হয় আন্দাজ করতে পারছি। রকিকে আগে থেকে অ্যালার্ট করেছেন সম্ভবত আপনার বন্ধু কালীপ্রসাদ। এবং খুব সম্ভব রকি এখন কালীপ্রসাদের আশ্রয়েই আছে।”
বাবু মিত্তিরের কথাটা বিশ্বাস হল না। তবৃ আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তুমি বুদ্ধিমান, একথা তো আগেই বলেছি। আবার কি বলতে হবে?”