ভয়ে হিম হয়ে গেলেন কালীপ্রসাদ। রেডিয়ো থেকে এ কার গলা শুনছেন তিনি? এ কি তারাপ্রসাদ নাকি?
রেডিয়ো আর কিছু বলল না। নব ঘোরাতে গিয়ে বুঝলেন, রেডিয়ো বন্ধই ছিল।
সভয়ে কালীপ্রসাদ তারাপ্রসাদের উদ্দেশে হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “তাই হবে।”
কালীপ্রসাদ দোতলায় নিজের ঘরে এসে চটপট শুয়ে পড়লেন। শরীর শীতে আর ভয়ে কাঁপছিল। তবে ঘুমিয়ে পড়তেও দেরি হল না।
সকালবেলায় উঠে একগাছা মজবুত পাকা বাঁশের লাঠি হাতে বাগানটা তন্ন-তন্ন করে খুঁজে দেখলেন কালীপ্রসাদ। কোথাও বাঘের চিহ্নমাত্র নেই। যোগেনকে গাঁয়ে পাঠালেন বাঘ কোনও মানুষ বা গোরু-ছাগল নিয়ে গেছে কি না। যোগেন এসে বলল, “কোনও ঘটনা ঘটেনি। তবে বুড়ো তারিণীখুড়ো বাঘের গন্ধ পেয়েছেন। শাকিলের গোয়ালে গোরুরা খুব দাপাদাপি করেছে রাতে। তার বেশি কিছু নয়।”
তারপর পায়রা-দৃত মারফত একটা খবর পাঠালেন বাবু মিত্তিরকে, “চিন্তা করিস না। বিপদে পড়লে কালীপুরে চলে আসিস। মরলে সবাই একসঙ্গে মরব। কালীপুর অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গা। অচেনা লোক এলে জানাজানি হয়ে যায়। কলকাতায় তো সেই সুবিধেই নেই।”
কালীপ্রসাদের খুব ইচ্ছে, পুত্র-বিরহে কাতর বাবু মিত্তিরের সঙ্গে রকির দেখা-সাক্ষাৎটা এখানেই হোক, তাঁর চোখের সামনে।
এর পর রকিকে খুঁজতে গিয়ে কালীপ্রসাদ দেখেন, সে ঘরে নেই। বিছানা পরিপাটি করে তোলা। বাথরুমে নেই। কোথাও নেই। কালীপ্রসাদ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। রকি গেল কোথায়?
যোগেনকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে যোগেন বলল, “দাদাবাবু তো হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে খুব ভোরবেলা দৌড়তে বেরোলেন।”
কালীপ্রসাদের দুশ্চিন্তা তবু রয়ে গেল। রকির বয়স কম, অভিজ্ঞতা কম। হুট করে বেরিয়ে পড়েছে, বিপদের কথাটা মাথায় না রেখেই। কালীপ্রসাদ উদ্বেগে বেরিয়ে পড়লেন। হাটখোলা, কালীমন্দির, মালোপাড়া ঘুরে কোথাও পেলেন না রকিকে। দু-চারজনকে জিজ্ঞেস করলেন। কেউ দেখেনি তাকে। হতাশ কালীপ্রসাদ ঘাটের কাছে চারদিক দেখলেন। কোথাও নেই। খোঁজ নিয়ে জানলেন, নৌকো করেও ওরকম কেউ আজ কোথাও যায়নি।
ফিরে আসছেন, হঠাৎ অদৃশ্য জায়গা থেকে কেউ ডাকল, “কালীকাকা!”।
কালীপ্রসাদ চারদিকে চেয়ে দেখলেন। প্রথমটায় কাউকে দেখতে পেলেন না। খালের ধারে একটু উত্তর দিকে পাণ্ডুরাজার বিশাল ঢিবি। জঙ্গলে একেবারে দুর্গম হয়ে আছে। পাণ্ডুরাজার ঢিবি নামটা গ্রামবাসীদেরই দেওয়া। এখানে কখনও ও-নামে কেউ রাজত্ব করেছিল বলে জানা নেই তাঁর। তবে ঢিবির মধ্যে কোনও ধ্বংসাবশেষ থাকলেও থাকতে পারে। ডাকটা, মনে হল, ওদিক থেকেই এল। কালীপ্রসাদ
একটু এগিয়ে গিয়ে অনুচ্চ গলায় ডাকলেন, “রকি নাকি রে?”
ঢিবির ওপরে ঝাঁকড়াঝাঁকড়া ঝোঁপঝাড়। তার ভেতর থেকে টুপি মাথায় একটা মূর্তি উঁকি দিল। মুখে একগাল হাসি। রকি।
কালীপ্রসাদ আর্তনাদ করে উঠলেন, “ওখানে কী করছিস? সাপখোপের আস্তানা, বিছুটি গাছ, ভীমরুলের চাক, কী নেই ওখানে?”
রকি তার গলায় ঝোলানো একটা বাইনোকুলার তুলে দেখিয়ে বলল, “ওয়াচ করছি।”
“ওয়াচ করতে হবে না। নেমে আয়। ওটা বিপজ্জনক জায়গা।”
“শীতকালে সাপ বেরোয় না কাকা। ভয় নেই। চিন্তা করছিলেন নাকি?”
“চিন্তা করব না? সাত সকালে কোথায় বেরিয়ে গেছিস!”
“সকালে রোজ দৌড়ই। অভ্যাস। দৌড় শেষ করে ঘাটের দিকে নজর রাখতে এখানে এসে থানা গেড়েছি। এ-জায়গাটা কিন্তু ওয়াচ করার পক্ষে চমৎকার জায়গা।”
বলতে বলতে রকি নেমে এল। কালীপ্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু সন্দেহজনক দেখলি নাকি?”
“না। গাঁয়ের লোকই আসছে-যাচ্ছে। ডেল্টার লোক বলে কাউকে মনে হল না।”
“তা বলে ডেল্টা বসে নেই। আজ হোক কাল হোক তারা হানা দেবেই।”
“ডেল্টা সম্পর্কে আপনি এত জানলেন কী করে কাকা?”
“তোর বাবার কাছ থেকেই সব শুনেছিলাম একসময়ে। আমার কাছে বাবু তো কিছুই গোপন করত না।”
রকি চিন্তিত মুখে বলে, “আমেরিকায় থাকতে আমিও অনেক কিছু। শুনেছি।”
“কী শুনেছিস?”
“পল নামে একটা লোক গোটা অগানাইজেশনকে চালায়। লোকটা ভয়ঙ্কর অহঙ্কারী, নিষ্ঠুর, আত্মকেন্দ্রিক আর প্রতিহিংসাপরায়ণ।”
“সে তো হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি।”
“আমেরিকার বিখ্যাত একটা খবরের কাগজে পল সম্পর্কে একটা বিরাট লেখা বেরিয়েছিল। তাতে একটা কথা ছিল। ডেল্টা অগানাইজেশন হিসেবে খুব পাওয়ারফুল বটে, কিন্তু সেটাকে চালায় একটাই লোক। মুশকিল হল, সেই লোকটা না থাকলে গোটা অর্গানাইজেশন ভেঙে ছয়-ছত্রখান হয়ে যাবে। কিন্তু পল এতই আত্মকেন্দ্রিক যে, ডেল্টার নেতৃত্ব আর কাউকে দেবে না। যাকে সেকেন্ড ইন কম্যান্ড বলে, পলের সেরকমও কেউ নেই।”
“বটে! তা হলে পল মরলেই সব ফরসা?”
“তাই অবস্থা ছিল। কিন্তু পল সম্প্রতি ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে এবং নিজের পুরনো সিদ্ধান্ত পালটে অর্গানাইজেশনটাকে ডিসেন্ট্রালাইজড বা বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা করছে! ফলে দলে প্রাধান্য এবং পদ পাওয়ার জন্য কিছু গণ্ডগোল শুরু হয়ে যায়। দু-চারটে খুন-জখমও হয় দলের মধ্যে। একটা গোষ্ঠী বেরিয়ে গিয়ে পালটা অর্গানাইজেশন করে। তবে যতদূর পড়েছি, ডেল্টা সেইসব গণ্ডগোল কাটিয়ে উঠেছে।”
কালীপ্রসাদ সতর্ক গলায় বললেন, “পলের ছেলেপুলে নেই বুঝি?”