রকি দমে গেল। বলল, “তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু এখন কী করা যাবে কাকা?”
“তোকে কিছু করতে হবে না। তুই শুধু চুপচাপ একটু গা-ঢাকা দিয়ে থাকবি। তোর একটা ওয়্যারলেস যন্ত্র আছে দেখছি। আগেই বলে রাখি, ওটা দিয়ে আবার ফস করে তোর বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলিস না।”
“না কাকা, আমি আর বোকামি করব না।”
নির্জন কালীপুরে ধীরে ধীরে বিকেল নেমে এল। তারপর সন্ধে হল। কালীমন্দিরে আরতি শুরু হল।
কালীপ্রসাদ তাঁর রান্নার ঠাকুর যোগেন আর কাজের লোক ধানুকে ডাকলেন। ল্যাবরেটরিতে তাদের দুজনকে বসিয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে খুব হুঁশিয়ার করে দিয়ে বললেন, “তোমরা দুজন আমার বিশ্বাসী লোক। সাহসীও। যদি ভয় পাও তা হলে তোমরা কিছুদিনের জন্য দেশে চলে যেতে পারো। আর যদি থাকতে চাও তা হলে বিপদের ঝুঁকি নিয়েই থাকতে হবে। এখন যা তোমাদের ইচ্ছা।”
ধানু মূকবধির হলেও কালীপ্রসাদের ঠোঁটের দিকে চেয়ে সব কথা বুঝতে পারে। সে মস্ত জোয়ান মানুষ। যে-কাজে গায়ের জোর লাগে সেকাজে তার খুব আনন্দ। সে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বুকে দুটো থাবড়া মেরে জানিয়ে দিল সে থাকবে।
যোগেন একটু বয়স্ক মৈথিলী ব্রাহ্মণ। খুব শান্ত, ধীর-স্থির। বুদ্ধিও রাখে। সে বলল, “কোনও চিন্তা নেই কালীবাবা। আমিও থাকছি।”
কালীপ্রসাদ জানতেন যে, তাঁর বিশ্বস্ত দুই অনুচর কোনও বিপদেই। তাঁকে ফেলে যাবে না। বললেন, “ঠিক আছে। এখন বাড়িতে কোথা দিয়ে শত্রু ঢুকতে পারে তা একটু খুঁজে দেখ। পিছনের দেওয়াল খানিকটা ভাঙা আছে। ওদিকটায় একটু কাঁটাতার লাগালে ভাল হয়। ফটকটাতেও মরচে ধরেছে।”
যোগেন একটু ইতস্তত করছিল। যেন কিছু একটা বলতে চায়। খুব মৃদু একটু গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “বাড়িতে নিশুত রাতে নানারকম শব্দ হচ্ছে। আগে হত না। তিন-চারদিন ধরে শুনতে পাচ্ছি।”
কালীপ্রসাদ সচকিত হয়ে বলেন, “কীরকম শব্দ?”
“কেউ যেন চলাফেরা করে।”
“আগে বলিসনি কেন?”
“বললে তো আপনি হেসে উড়িয়ে দেবেন। এ বাড়িতে মানুষ ঢোকে, প্রেতাত্মারাই ঘুরে বেড়ায় হয়তো।”
কালীপ্রসাদ একটু চুপ করে থেকে বললেন, “সাবধান থাকি, এখন যা।”
রাতে আজ একটু তাড়াতাড়িই খাওয়া সেরে রকি তার ঘরে শুতে চলে গেল। পথশ্রমে ক্লান্ত সে। কালীপ্রসাদ একা নানা ভাবনা-চিন্তা নিয়ে ল্যাবরেটরিতে বসে লেখালেখি করতে লাগলেন। সময়ের জ্ঞান ছিল না। কিন্তু হঠাৎ একটা চেনা বোঁটকা গন্ধ পেয়ে ঘন-ঘন বাতাস শুকলেন। কালীপ্রসাদ সুন্দরবনের মানুষ। সবই তাঁর নখদর্পণে। জঙ্গলে ঘুরে-ঘুরে তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতা হয়েছে। উপরন্তু তিনি নিজেই একসময়ে বাঘ পুষতেন। সেই বাঘের নামই দিয়েছিলেন ‘হালুম। কুকুরের মতোই পোষ মেনে গিয়েছিল। আট বছর বয়সে সে হয়ে উঠেছিল পেল্লায় চেহারার। সেই সময়ে বিষাক্ত সাপের কামড়ে সে মারা যায়। আজও সেই শোক ভুলতে পারেন না কালীপ্রসাদ।
গন্ধটা যে নির্ভুল কোনও বাঘবাবাজির গায়ের গন্ধ, তাতে কোনও ভুল নেই। কিন্তু বাঘ এলে জানান পড়ে যায়। কালীপুর সুন্দরবনের প্রত্যন্ত প্রদেশে হলেও বাঘের জঙ্গল এখন দূরে সরে গেছে। এ-অঞ্চলে গত পাঁচ-সাত বছরে বাঘের আনাগোনা নেই। তবে বাঘ এল কোথা থেকে?
কালীপ্রসাদ চুপিসারে উঠলেন। নিঃশব্দে প্রথমে পুবের জানালার কাছে এসে খুব আস্তে পাল্লা ফাঁক করলেন। এদিকে গন্ধটা তেমন তীব্র নয়। জানালা বন্ধ করে উত্তরদিকের জানালায় গিয়েও পরীক্ষা করলেন। এদিকে গন্ধ আরও কম। এবার ধীরে ধীরে গিয়ে দক্ষিণের জানালাটা একটু ফাঁক করতেই ভক করে গন্ধটা যেন নাকে ধাক্কা মারল। বাইরে ঘন কুয়াশা। খুব ঠাণ্ডা। গাছের পাতায় শিশির পড়ার শব্দ হচ্ছে টুপটাপ। অন্ধকারে আর কিছু দেখা গেল না।
কালীপ্রসাদ ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে আবার দক্ষিণের জানালায় এসে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে বাইরে চেয়ে রইলেন। অজ পাড়াগাঁয়ে থাকেন বলেই কালীপ্রসাদের চোখের দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ। চট করে অন্ধকার সয়ে যায়। অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে তিনি বাগানের গাছপালা, ঝোঁপঝাড় সবই চিনতে পারছিলেন। কোথাও কোনও নড়াচড়া বা শব্দ নেই। ধৈর্য হারালেন না। বাঘ অতিশয় চতুর জন্তু। চট করে ধরা দেয় না। পনেরো মিনিট থেকে আধঘণ্টা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর তিনি হঠাৎ শক্ত হয়ে গেলেন। সামনেই মল্লিকার ঝাড়। পর-পর অনেক গাছ। তারই ভিতর থেকে খুব ধীরে ধীরে একটা মস্ত ছায়ামূর্তির মতো বাঘটা উঠে দাঁড়াল। বেশ আলস্যজড়িত ভাবভঙ্গি। একবার যেন মুখটা ঘোরালো জানালার দিকে, যেখানে কালীপ্রসাদ দাঁড়িয়ে আছে। দৃখানা জ্বলন্ত চোখ অন্ধকারে ধকধক করে উঠল। বুকটা কেঁপে গেল কালীপ্রসাদের। বাঘটা একবারই দৃষ্টিক্ষেপ করে দুলকি চালে ধীর গতিতে আরও দক্ষিণের দিকে চলে গেল।
কালীপ্রসাদ দুশ্চিন্তায় পড়লেন। গাঁয়ে বাঘ আসাটা খুব সুখের ব্যাপার নয়। সুন্দরবনের সব বাঘই মানুষখেকো। বাঘের খবরটা জানান দেওয়া দরকার। ছাদে উঠে ক্যানেস্তারা পেটালে গাঁয়ের লোক সতর্ক হয়ে যাবে।
কালীপ্রসাদ উঠতে যাচ্ছিলেন। টেবিলে রাখা ট্রানজিস্টার রেডিয়োতে স্ট্যাটিকের মৃদু শব্দ পেয়ে থামলেন। রেডিয়োর খবর শোনাটা তাঁর নেশার মতো। গানটানও শোনেন। রেডিয়োটা খুলে রেখেই কাজ করছিলেন। হয়তো অন্যমনস্ক ছিলেন বলে বন্ধ করতে ভুলে গেছেন। রেডিয়োটা বন্ধ করতে নবের দিকে হাত বাড়াতেই শুনতে পেলেন, “দিস ইজ অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো… ওহে কালীপ্রসাদ, ক্যানেস্তারা পেটানোর দরকার নেই।”