–তোমার অবাধ্য ছেলে রকি।
নিজের অজান্তেই বাবু মিত্তিরের চোখ থেকে অজস্রধারে আনন্দাশ্রু বয়ে যাচ্ছিল। তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। নিষ্ঠুর মুষ্টিযোদ্ধার বুকের ভেতরে যে এত চোখের জল ছিল তা কে জানত!
সামলে উঠতে তাঁর মিনিটদশেকের মতো সময় লাগল। ততক্ষণে পলাশ একটাও কথা বলল না। বাবু মিত্তির শান্ত হওয়ার পর সে নরম
গলায় বলল, “কাকাবাবু, ঘটনাটা যেমন আনন্দের, তেমনই উদ্বেগেরও।”
বাবু মিত্তির অবাক হয়ে বললেন, “ওকথা কেন বলছ? কতদিন পর আমি আমার হারানো ছেলের খবর পেলাম!”
“সেটা না পেলেই বোধ হয় ভাল ছিল।”
“তার মানে?”
“আপনি যেমন রকি খবর পেলেন, তেমনই খবরটা পেয়ে গেল ডেল্টাও।”
বাবু মিত্তিরের হঠাৎ যেন চৈতন্য হল, “কী করে বুঝলে?”
“বোঝা খুব সহজ। খামের মুখটা খুলে আবার আঁটা হয়েছে, ভাল করে দেখলেই বুঝতে পারবেন।”
বাবু মিত্তির খামটা তুলে নিয়ে দেখলেন, সত্যিই ফ্ল্যাপটা একটু ছেঁড়া, আঠার একটা দাগ রয়েছে।
“আরও একটা কথা।”
“কী কথা পলাশ?”
“চিঠিটা এসেছে আজ সকালে। কিন্তু এ-সময়ে কখনও ডাকপিয়ন আসে না। আসে দুপুরে এবং কখনও-সখনও বিকেলেও। খামের ওপর মোহরের ছাপ দেখুন। অস্পষ্ট হলেও বোঝা যায়, চিঠিটার আসল ডেলিভারির তারিখ ছিল গতকাল। তার মানে চিঠিটা একদিন কারও কাছে ছিল। আজ সকালে আপনার চিঠির বাক্সে ফেলে গেছে।”
বাবু মিত্তির সবই বুঝলেন। ফ্যাকাসে মুখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে তিনি তাড়াতাড়ি টেলিফোন তুলে আমেদাবাদে রকির নম্বর ডায়াল করলেন। একটা মোটা গলা ইংরেজিতে বলল, “ওয়েস্টার্ন ইলেকট্রনিক্স।”
বাবু মিত্তির রকির নাম বললেন। অপারেটর একটা কানেকশন দিল। দ্বিতীয় আর-একজন তোক ধরতেই বাবু মিত্তির নিজের পরিচয় দিয়ে রকির সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। লোকটা বলল, “সে তো দুদিন হল নিপাত্তা। কোনও খবর নেই। তার বাড়িতেও একটা হামলা হয়ে গেছে কাল রাতে।”
বাবু মিত্তির ফোন রেখে অবসন্নভাবে চোখ বুজলেন। এবার আনন্দাশুর বদলে তাঁর দু চোখ থেকে শোকের জলধারা নেমে এল। ফিসফিস করে বললেন, “ঠিকই বলেছ পলাশ। চিঠিটা রকি না লিখলেই বোধ হয় ভাল করত।”
৫. কালীপ্রসাদ যে আজেবাজে
কালীপ্রসাদ যে আজেবাজে কথা বলার মানুষ নন তা রকি ভালই। জানে। তবে বয়সে মাথার গণ্ডগোল দেখা দিলে অন্য কথা। সাতপাঁচ ভেবে রকি কালীকাকার কথা অমান্য করল না। টেলিফোন পাওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে প্লেনে সিট বুক করল এবং পরদিন বিকেলেই দিল্লি পৌঁছে তার পরদিন সকালের ফ্লাইট ধরে কলকাতায় চলে এল। কালীপুর পৌঁছতে অবশ্য বেলা গড়িয়ে গেল। নৌকো থেকে নেমে যখন ঘাটে উঠছে তখন ঘাটেই কালীপ্রসাদের সঙ্গে দেখা। নিতাই মাঝির ঝোঁপড়ায় উদ্বিগ্ন মুখে বসে ছিলেন। রকিকে দেখে লাফিয়ে উঠলেন, “এসেছিস!” বলে কালীকাকা একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরলেন আনন্দে।
রকি মৃদু হেসে বলল, “আপনি কি সারাদিন এখানে বসে আছেন নাকি আমার জন্য?”
“বেলা ন’টা থেকে বসে আছি। গতকালও ছিলাম। রাতে ঘুমোতে পারিনি।”
“কিন্তু ব্যাপারটা কী কালীকাকা?”
“আগে বাড়ি চল, তারপর বলব।”
রকি স্নান করে ভাত খাওয়ার পর কালী প্রসাদ তার কাছে প্রায় সবই খুলে বললেন। বাবু মিত্তির যে একসময়ে ডেল্টার হয়ে কাজ করেছেন এবং কিছু-কিছু অত্যন্ত অন্যায় কাজও করেছেন, তাও রেখেঢেকে বললেন।
রকির মুখ শুকিয়ে গেল। সে বলল, “বাবার মুখে তো কখনও এসব শুনিনি। আমেরিকায় যখন ছিলাম তখন ডেল্টার কথা অনেক শুনেছি, খবরের কাগজেও পড়েছি। ওদের ভয়ে সবাই তটস্থ। ওরা যদি বাবার ক্ষতি করতে চায় তা হলে তো ভয়ের কথা।”
“শুধু তোর বাবা তো নয়, এখন তাদের নজর তোর ওপরেও পড়েছে বলে আমার বিশ্বাস। এতদিন ডেল্টা তোর খবর জানত না। কিন্তু বাবু মিত্তিরের কাছে তুই চিঠি লেখার পর তারা সব জেনে গেছে। এখন বাবুকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ডেল্টা আগে তোকে মারবার চেষ্টা করবে।”
রকি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বলল, “দাঁড়ান, সত্যিই ডেল্টা আমার ওপর অ্যাটেম্পট করেছে কিনা তা এখনই খবর নিচ্ছি।”
রকি তার সুটকেস খুলে একটি অত্যাধুনিক খুদে যন্ত্র বের করল। তারপর কিছুক্ষণের চেষ্টায় আমেদাবাদে নিজের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করল। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর সে গম্ভীর মুখে যন্ত্রটা ফের গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলল, “আপনার কথাই ঠিক। আমি যে-ফ্ল্যাটটায় থাকি সেখানে দরজা ভেঙে কারা ঢুকেছিল। ফ্ল্যাট তছনছ করে গেছে। আমার বাড়িওয়ালা পুলিশে আর আমার অফিসে খবর দিয়েছে। ডেল্টার নেটওয়ার্ক তো দেখছি দারুণ ভাল।”
কালী প্রসাদ গম্ভীর মুখে বললেন, “এখন একটাই দুশ্চিন্তা, ওরা তোকে খুঁজতে খুঁজতে এত দূরেও হানা দেবে কিনা। দিলেই বা আমরা কী করতে পারি।”
রকি মৃদুস্বরে বলে, “কাকা, আমি বক্সার হতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু আমি তো আমার বাবারই ছেলে। অত সহজে ভয় পাই না। আপনি অত দুশ্চিন্তা করবেন না। আমাদের মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। আচ্ছা, বাবা কি ব্যাপারটা পুলিশকে জানিয়েছেন?”
“তা জানি না। তবে পুলিশকে জানালে তেমন কোনও লাভ হবে বলে তো মনে হয় না।”
“তবু জানিয়ে রাখাটা ভাল।”
কালীপ্রসাদ দৃঃখিত গলায় বললেন, “আমাদের দেশের পুলিশ তো কোন ছার, বাবুর কাছে শুনেছি, সে-দেশের পুলিশই তাদের কিছু করতে পারে না। তার ওপর পুলিশ ডাকলে পুলিশেরই ভেক ধরে তারা বাড়িতে ঢোকার সুযোগ পাবে। অবশ্য সুযোগের অভাব তাদের নেই, রেডিয়ো অ্যাকটিভ ছুঁচ তো দিব্যি অনায়াসে বিছানায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেল।”