“কিন্তু …”।
“হ্যাঁ, ওই কিন্তুটার কথাই আসল কথা। রাউল আমাকে ভালবেসেছিল ঠিকই, কিন্তু একটা পাপচক্রে ভিড়িয়ে আমার জীবনটাও সে নষ্ট করতে বসেছিল। অবশ্য তাকে দোষ দিই না। সে ছেলেবেলা থেকেই হয়তো ওসবে অভ্যস্ত। কাজেই খুন, ড্রাগের ব্যবসা বা চোরাচালানকে খারাপ বলে ভাবতেই শেখেনি।”
“এবার আসল কথাটায় আসুন কাকাবাবু। পল আপনাকে মারার জন্য এই বিরাট প্ল্যানিং কেন করছে?”
বাবু মিত্তির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “অনেকের সন্দেহ। রাউলকে আসলে খুন করেছিলাম আমি।”
“আপনি! আপনি কেন খুন করবেন?”
“মেক্সিকো থেকে পালিয়ে আসার আগে আমাকে কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হয়েছিল। আমার এক বিশ্বস্ত কালো বন্ধু ছিল, তার বাড়িতে। সে আমাকে বলেছিল, শহরে জোর গুজব যে, রাউলকে খুন করেছে বাবু। কারণ রাউলের জন্যই সে অলিম্পিকে সোনার মেডেল পায়নি। তা ছাড়া রাউল যে-গুলিতে মারা যায় তাও ছিল নাইন মিলিমিটারের এই পিস্তলের।”
“রাউলকৈ আপনি সত্যিই মারেননি তো কাকাবাবু?”
“না পলাশ। রাউল আমার বন্ধু ছিল। ষড়যন্ত্রটার কথা তখনও আমার জানা ছিল না। অনেক পাপ করেছি বটে, তবে এ পাপটা করিনি।”
“পলের বয়স এখন কত হবে কাকাবাবু?”
“হয়তো সত্তর বা সামান্য বেশি। পুত্রশোক সে আজও ভোলেনি। তার প্রতিশোধস্পৃহা ভয়ঙ্কর।”
“বুঝতে পারছি। অ্যাটাচি কেস-এ আপনি কত ডলার পেয়েছিলেন?”
“শুনে কী করবে? তবে বলতে বাধাও নেই। আমার পাঁচ লক্ষ ডলার ছাড়াও এতে ছিল আরও পাঁচ লক্ষ। বাড়তি পাঁচ লক্ষ হয়তো অন্য কোনও পে-অফ-এর জন্য ছিল। মোট এক মিলিয়ন ডলার। মিলিয়নের বাংলা কী বলল তো!”
“নিযুত।”
“হ্যাঁ, এক নিযুত ডলার। ও-টাকা পলের কাছে কিছুই নয়। কিন্তু আমার কাছে অনেক টাকা।”
পলাশ একটু হেসে বলল, “আপনি আজ অনেক কথা আমাকে অকপটে বললেন, তবু কিছু গোপনও করছেন। রেডিয়ো অ্যাকটিভিটি, ক্যানসার ইত্যাদি নিয়ে আপনার প্রশ্ন আসছে কেন?”
বাবু মিত্তির নির্বিকার মুখে বললেন, “হতে পারে তারা আমাকে বায়োলজিক্যাল অ্যাটাক করতে চাইছে। সব দিক দিয়ে চিন্তা করছি।”
“কাকাবাবু, কাঁকড়াবিছের গল্পটা কি সত্যি?” বাবু মিত্তির হাসলেন, “সত্যি না হলেও সত্যি বলেই ধরে নাও। আর কিছু জিজ্ঞেস কোরো না।”
“ঠিক আছে।” বলে পলাশ চলে গেল।
বাবু মিত্তির একটু স্বস্তি বোধ করছেন। ডেল্টা তাঁকে ক্যানসার উপহার পাঠিয়েছে। সুতরাং তারা এখন অপেক্ষা করবে। লক্ষ্য রাখবে। তাদের প্ল্যান যে ভেস্তে গেছে সেটা না জানা অবধি তারা হয়তো আর কিছু করবে না। সুতরাং টান-টান দুশ্চিন্তা নিয়ে থাকার দরকার নেই।
সারাদিন বাবু মিত্তির আজ একটু হালকা মেজাজে রইলেন। তাঁর বক্সিংয়ের ছাত্ররা এলে আজ তিনি নিজে তাঁদের সঙ্গে অনেকক্ষণ স্পারিং করলেন। শরীরটা অনেক ঝরঝরে লাগল। দুপুরে আজ তৃপ্তি করে খেলেনও।
খেয়ে উঠে কালীপ্রসাদকে একটা চিঠি লিখলেন, “কালী, তুই কি পিশাচসিদ্ধ, নাকি সত্যিই তন্ত্রমন্ত্র জানিস, নাকি সত্যিই তোর পোষা ভূত আছে? অত দূর থেকে কি করে ছুঁচের কথা টের পেলি? ছুঁচ সত্যিই ছিল। আজ সকালেই ডেল্টা মৃত্যুবাণটি আমাকে উপহার পাঠিয়েছে। তোর জন্যই বেঁচে গেলাম। কিন্তু দৈবের ওপর নির্ভর করে কতবার বাঁচা যাবে? আমি পাপী লোক, ঈশ্বর আমার জন্য বেশি মাথা ঘামাবেন বলে আমার মনে হয় না। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন এখন রকিকে, তোর কাছে একটু আশার আলো দেখেছিলাম। তার কোনও খবরই তো আর দিলি না! তোর আশায় বসে আছি।”
ছাদে উঠে পায়রাটির পায়ে চিরকুট বেঁধে উড়িয়ে দিলেন। বিকেলে বাগানে কাজ করার অছিলায় একটা কামিনীঝোঁপের পিছনে ঘের-পাঁচিলের কাছ ঘেঁষে খুরপি দিয়ে মাটিতে একটা গর্ত খুঁড়লেন। তারপর চারদিক ভাল করে দেখে নিয়ে কৌটোসমেত ছুঁচটিকে কবরস্থ করলেন তার মধ্যে।
শোওয়ার ঘরের তোশকটাকে বর্জন করা উচিত। কিন্তু সেটা করতে গেলে পাঁচজনের চোখে পড়ার সম্ভাবনা। ডেল্টার চোখ কতখানি খর নজর রাখছে তাঁর ওপর তা তো তিনি জানেন। সুতরাং ঘরে এসে বিছানাটি নিজেই পরিপাটি করে পাতলেন। স্থির করলেন, রাতে
মেঝেতে আলাদা একটা বিছানা পেতে শোবেন।
দিন দুই বেশ ঘটনাবিহীন কাটল। দুদিন বাদে সকালে হঠাৎ পলাশ একটু উত্তেজিতভাবে তাঁর ঘরে এসে ঢুকল। হাতে একটা চিঠি। বলল, “কাকাবাবু, আপনার ছেলের নাম তো রকি!”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। কেন বলো তো!”
“এ-চিঠিটা দেখুন তো, তারই কিনা।”
খামটা হাতে নিয়ে উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলেন বাবু মিত্তির। খামের ওপরেই বাঁ দিকে নিজের নাম ও ঠিকানা লিখে দিয়েছে রকি। রকি বেঁচে আছে এইটেই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল তাঁর কাছে।
খামটা খুলতে যাচ্ছিলেন, পলাশ বাধা দিয়ে বলল, “একটু দাঁড়ান কাকাবাবু, খামটা একটু লক্ষ করুন।”
“খামটা! কেন, কী লক্ষ করব?”
“খামটা ভোলা হয়েছে, তারপর বন্ধ করা হয়েছে। ফ্ল্যাপটা একটু ছেঁড়া।”
বাবু মিত্তির এই সময়ে পলাশের ডিটেকটিভগিরি মোটেই পছন্দ করলেন না। বললেন, “দাঁড়াও বাপু, আগে চিঠিটা দেখি। এ চিঠির মতো বড় সম্পদ এখন আর আমার কিছু নেই।”
এই বলে বাবু মিত্তির খামের মুখটা খুলে চিঠিটা বের করলেন। বেশ ছোট চিঠি। রকি লিখেছে :
শ্রীচরণেষু বাবা,
তোমার কাছে আমার অনেক অপরাধ জমা হয়েছে। তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। হয়তো আমার জন্য তোমার কষ্টও হয়েছে খুব। আজ তোমাকে জানাতে আপত্তি নেই, আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে কালীপুরে কালীকাকার কাছে চলে গিয়েছিলাম। কালীকাকা এক অসাধারণ মানুষ। তিনি আমাকে দিল্লিতে পাঠিয়ে পড়াশোনা করান। আমি আমেরিকা থেকে ইলেকট্রনিক্স এঞ্জিনিয়ারিং-এ ডক্টরেট করে এসেছি। খুব শিগগিরই আমি তোমার কাছে যাব। তোমার জন্য আমার বড় মন কেমন করে। আমার সব অপরাধ ক্ষমা করে দিয়ে। দেখা হলে সব তোমাকে বলব। আমি বেঁচে আছি, ভাল আছি। চিন্তা কোরো না। প্রণাম নও।