“আপনার কাছে কি অন্য কোনও অস্ত্র ছিল না?”
বাবু মিত্তির কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জামার তলায় হাত ভরে তাঁর পিস্তলটা বের করে আনলেন। বললেন, “এটা ছিল।”
পলাশ একটা শ্বাস ফেলে বলে, “এবার বলুন।”
বাবু মিত্তির পিস্তলটা আবার শোলডার হোলস্টারে ভরে রেখে বললেন, “তুমি সত্যিই বুদ্ধিমানগজপতি আমাকে ভুল লোক দেয়নি। যাই হোক, পার্টি যখন চলছিল তখন হঠাৎ রাউল দৃজন সিকিউরিটির হাতে ধরা পড়ে। কীভাবে পড়েছিল তা আমি জানি না। সেই বিশাল পার্টিতে সে আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবে একটা ঝটাপটি আর চেঁচামেচি শুনে আমি এগিয়ে গিয়ে দেখি, রাউলের সঙ্গে দুটো লোকের মারপিট হচ্ছে। রাউল অলিম্পিকের পদক পাওয়া বক্সার। তার সঙ্গে পেরে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়। সে খুঁসি চালিয়ে দুজনকে হারিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে যায়। সে-সময়ে সে পিস্তলও বের করে। আর তখনই গুলি চলে। আমি আর অপেক্ষা করিনি। কারণ যাকে মারব বলে যাওয়া সেই লোকটিকে চোখের পলকে সিকিউরিটি গার্ডরা ঘিরে ফেলে পার্টি থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। আমি গতিক সুবিধের নয় দেখে পালাই। কিন্তু তখন লোভ ছিল প্রচণ্ড। ভাবলাম এক ঢিলে দুই পাখি মারব। এই খুনখারাপির বিপজ্জনক কাজ আর করব না, আর নিজের আখেরটাও গুছিয়ে নেব। পার্টি থেকে বেরিয়ে এসে আমি আমাদের স্পোর্টস কারটি নিয়ে সোজা সেই হোটেলে গিয়ে হাজির হই। ডলফিন গম্ভীর মুখে অপেক্ষা করছিল তার ঘরে।
সঙ্গে মস্ত বড় অ্যাটাচি কেস। আমি গিয়ে সোজা তাকে বললাম, কাজ হাসিল, টাকা দাও। সে গম্ভীর মুখে বলল, রাউল কোথায়? আমি বললাম, সে পরে আসছে। একটু ঝামেলায় পড়েছে।”
বাবু মিত্তির চোখ বুজে যেন স্মৃতিটাকে আর একটু ঝালিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, “কিন্তু ডলফিন বোকা নয়, সে যেন পচা ইঁদুরের গন্ধ পেয়ে নাক কুঁচকে বলল, রাউল আর তুমি একসঙ্গে না এলে টাকা দেওয়ার হুকুম নেই। অপেক্ষা করো, রাউলকে আসতে দাও। আমি রেগে গিয়ে বললাম, রাউল তার সময়মতো আসবে, আমি অপেক্ষা করব কেন? সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, তুমি এখনও জানো না রাউল কে। জানলে ওকথা বলতে না। যে-টাকাটা তুমি আজ পাবে অন্য লোকে একাজের জন্য এর দশ ভাগের এক ভাগও পায় না। তুমি পাচ্ছ রাউলের দয়ায়।”
“আপনি তখন একথাটার অর্থ বুঝতে পারেননি?”
“না। তুমি কি পারছ?”
“মনে হয় পারছি।”
“আমি তো আগেই বলেছি তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। আমি বুঝতে পারিনি, কারণ আমি তখন ভীষণ উত্তেজিত আর অস্থির। হাতে সময় নেই। যত তাড়াতাড়ি পালানো যায় ততই মঙ্গল। ডলফিন আমার মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করেছিল। সে এক হাতে হোলস্টার থেকে রিভলভার বের করতে করতে অন্য হাতে অ্যাটাচিটা চেপে ধরল। কিন্তু ডলফিন মাঝবয়সী মানুষ। গুণ্ডা হলেও আমার মতো চটপটে নয়, গায়ে তত জোরও নেই। আমি তাকে একটা ঘুসি মেরে শুইয়ে দিলাম আর হাত মুচড়ে রিভলভার আর অ্যাটাচি দুটোই কেড়ে নিলাম। ডলফিন মেঝেতে পড়ে গিয়েও আমার দিকে চেয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, রাউল কোথায়? রাউলের যদি কিছু হয় তো তোমার রক্ষে নেই। অলিম্পিকে প্রাণে বেঁচে গেছ, এবার বাঁচবে না। পল তোমাকে শেষ করবেই।”
“আপনি তখনও বুঝতে পারেননি?”
“না। বোধ হয় তখন থেকেই আমার মাথায় কার্যকারণ অনুধাবন করার ক্ষমতা কমতে শুরু করে। তা ছাড়া টাকার লোভ, মৃত্যুভয়, পালানোর তাড়া, সব মিলিয়ে মাথার ঠিক ছিল না। আমি রিভলভারের বাঁট দিয়ে মেরে ডলফিনকে অজ্ঞান করে পালিয়ে যাই। অনেক কষ্ট করে, নানা ঘটনা ঘটিয়ে প্রথমে আফ্রিকা, তারপর দেশে ফিরে আসি।
“ঘটনাটা যদি আগে জানতাম তা হলে ডেল্টা আপনাকে কেন এভাবে মারতে চায় তা আগেই বুঝতে পারতাম।”
বাবু মিত্তির মৃদু হেসে বললেন, “বুঝতে পেরেছ তা হলে?”
“অনেকটা।”
“কী বুঝেছ বলো তো?” পলাশ গম্ভীর মুখে বলল, “রাউল আসলে পলের ছেলে, কিন্তু সেটা ওরা আপনাকে বুঝতে দেয়নি কখনও।”
“শাবাশ!” বলে বাবু মিত্তির হেসে উঠলেন।
“অলিম্পিকে আপনার হাত থেকে রাউলকে বাঁচানোর জন্য পলই তার লোককে লাগিয়েছিল। সেই লোকই আপনাকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার লোভ দেখায়।”
“বুস আই! চমৎকার।”
“সেই লোকটা যখন লড়াই ছেড়ে দেওয়ার জন্য আপনাকে পাঁচ হাজার ডলার দিতে চেয়েছিল তখন কি আপনার মনে হয়নি ও রাউলের লোক?”
বাবু মিত্তির মাথা নেড়ে বললেন, “না, মনে হয়নি। তার একটা সঙ্গত কারণ আছে। বিশ্ব পর্যায়ের যে-কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়েই একটা বাজি ধরাধরি হয়। অনেক টাকার খেলা। কোনও একজন বক্সারের ওপর কেউ হয়তো এক লাখ ডলার বাজি ধরল। তখন বাজি জেতবার জন্য সে প্রতিদ্বন্দ্বী বক্সারকে পাঁচ-দশ হাজার ডলার দিয়ে হেরে যেতে রাজি করিয়ে নেয়। এ-জিনিস আকছার হচ্ছে। কাজেই রাউলকে সন্দেহ
করার কিছু ছিল না।”
“সেই লোকটাই কি আপনাকে বিষ দিয়েছিল?”
বাবু মিত্তির মাথা নেড়ে বললেন, “না। পলের অনেক লোক ছিল। অলিম্পিক ভিলেজে আমি রোজ সকালে সেন্ট্রাল ডাইনিং হল-এ গিয়ে ব্রেকফাস্ট করতাম। আমার মনে হয় সেই সময়ে আমার দুধে কেউ কিছু মিশিয়ে দেয়। ওকাজটা খুব শক্ত ছিল না।”
“এবার ব্যাখ্যাটা আপনিই করুন।”
“ব্যাখ্যা খুব সোজা। আমি বোকা বলেই এতদিন বুঝতে পারিনি। সবচেয়ে করুণ ব্যাপারটা কী জানো? সেটা হল রাউল। সে হয়তো বড় বক্সার ছিল না, কিন্তু হৃদয়বান ছিল। আমাকে সোনার মেডেল থেকে তার বাবা বঞ্চিত করেছে এটা সে কখনওই ভোলেনি। তাই নানাভাবে ক্ষতিপূরণ করতে চেয়েছে। আর্জেন্টিনায় নেমন্তন্ন করা, বাপের দলে ভেড়ানো, বেশি-বেশি বখরা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা, এ-সবই তার ভালবাসার নিদর্শন।”