“ডাক্তারদের বোলো তার চিকিৎসার ব্যাপারে যেন কোনও ত্রুটি না। হয়। টাকা যতই লাগুক।”
“সেটা ডাক্তাররা জানেন। চিকিৎসার ত্রুটি হচ্ছে না।”
“তুমি আজ একটু বেড়িয়েটেড়িয়ে এসো, মনটা ভাল থাকবে। আর সবসময়ে সাবধান থেকো।”
“আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই, কিছু মনে করবেন।”
“না, আমাকে সবই জিজ্ঞেস করতে পারো।”
“আপনাকে মারবার জন্য ডেল্টা যেরকম বিরাট প্ল্যানিং নিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে তাদের ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই নয় কি? বিশেষ করে ঘটনা ঘটে যাওয়ার এত বছর পর।”
“ডেল্টা বিশ্বাসঘাতকদের কখনও ক্ষমা করে না।”
“সেটা বুঝলাম। সেক্ষেত্রে আপনাকে তারা আচমকা গুলি করে বা স্ট্যাব করে মেরে ফেলত। আগে থেকে চিঠি দিয়ে, আপনাকে সতর্ক হওয়ার সুযোগ দিয়ে তারপর মারত না। ব্যাপারটার মধ্যে একটু অস্বাভাবিকতা আছে। একটু যেন বাড়াবাড়িও।”
“আমারও তাই মনে হচ্ছে।”
“বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে তারা খুব ঝুঁকি নিচ্ছে। সাধারণত এইসব ভাড়াটে খুনি বা অপরাধীর দল এরকম করে না। আপনার বেলায় করছে কেন? আপনি কি ওদের কোনও গুরুতর গুপ্ত কথা জানেন?”
বাবু মিত্তির খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তুমি খুব বুদ্ধিমান। জীবনে উন্নতি করবে।”
“ওটা আমার কথার জবাব হল না কিন্তু।”
বাবু মিত্তির আবার কিছুক্ষণ চুপ করে শূন্য চোখে চেয়ে রইলেন। তারপর গলাখাঁকারি দিয়ে মৃদু স্বরে বললেন, “তা হলে বোসো। আমার আর লুকোবার কিছুই নেই। তুমি খুব ভাল ছেলে। তোমাকে বললে হয়তো আমার কর্মফল কিছুটা কাটবে।”
পলাশ বসল। বলল, “দাঁড়ান। কথাগুলো বলবার আগে ভাল করে ভেবে নিন, আমাকে বললে আপনার কোনও ক্ষতি হবে কি না।”
বাবু মিত্তির ম্লান হেসে বললেন, “ক্ষতির ভয় আর কিছু নেই। আমার জীবনটা তো পার করেই দিলাম। তোমার অনুমান খুব ভুল নয়। আমাকে মারার জন্য যে বিরাট জাল ফেলেছে ডেল্টা, তা অকারণ নয়। ঘটনার শুরু অলিম্পিকে। আমাকে সাহেবরা বলত কোব্রা। সেটা অকারণে বলত না। অলিম্পিকের আগেই বিভিন্ন আন্তজাতিক প্রতিযোগিতায় আমার রেকর্ড এত ভাল ছিল যা ভারতীয় বক্সারদের কেউ কখনও পারেনি। অলিম্পিকে সোনার মেডেল আমার বাঁধাই ছিল। আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা কেউই আমার সমকক্ষ ছিল না। প্রথম দুই রাউন্ড আমি জিতেছিলাম ফাস্ট রাউন্ড নক আউটে। পরেরগুলোও তাই জিততাম। সেই সময়ে অলিম্পিক ভিলেজে একদিন একজন লোক আমাকে এসে ধরল। সে বলল, অলিম্পিকের পর সে আমাকে আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে প্রফেশন্যাল বক্সিং-এ নামাতে চায়। প্রফেশন্যাল বক্সিংয়ে আমেরিকা দুনিয়ার সেরা দেশ। লাখো লাখো ডলারও আয় করা যায়। আমি এ-প্রস্তাবে দারুণ নেচে উঠলাম। লোকটা আমাকে আগাম এক হাজার ডলারও দিয়েছিল। থার্ড রাউন্ডে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল রাউল নামে দক্ষিণ আমেরিকার একটি ছেলে। ইজি অপোনেন্ট। কিন্তু সেই লোকটা বলল, লড়াইটা যদি ছেড়ে দিই তবে সে আমাকে আরও পাঁচ হাজার ডলার দেবে। শুনে আমি অবাক হলাম। কিন্তু রাজি হইনি।”
বাধা দিয়ে পলাশ বলল, “রাউল নামে একটি ছেলেই না মেক্সিকোর সেই ঘটনায় আপনার সঙ্গী ছিল।”
বাবু মিত্তির মৃদু হাসি হেসে বললেন, “তোমার স্মৃতিশক্তি চমৎকার। হ্যাঁ, এই সেই রাউল। তার সঙ্গে লড়াইয়ের দিনই আমি পেটের ব্যথায় কাতর হয়ে পড়ি। হাসপাতালেও যেতে হয়েছিল। কোনও বিষ কোনওভাবে আমার শরীরে কেউ ঢুকিয়ে দেয়। এতদিন ধরে ভেবে-ভেবেও আমি ষড়যন্ত্রটা ধরতে পারিনি। ঘটনাগুলোকে জুড়তেও পারিনি।”
“এখন কি পারছেন?”
“বোধ হয় পারছি। রাউল আমার বিরুদ্ধে ওয়াক ওভার পেয়ে সেমিফাইনালে যায়। কিন্তু সুবিধে করতে পারেনি। শেষ অবধি সে ব্রোঞ্জ মেডেল জিতেছিল। তবে ভিলেজেই সে এসে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে।”
“আর আমেরিকার সেই লোকটি?”
“সেই কথাতেই আসছি। বক্সিং কম্পিটিশন শেষ হওয়ার পরই আমার সঙ্গে তার দেখা করার কথা। তার নাম ছিল জন লিডো। অন্তত ওই নামটাই সে বলেছিল। কিন্তু লিডো আর আমার সঙ্গে দেখা করল না। একেবারে হাওয়া হয়ে গেল। অলিম্পিকের পর দেশে ফিরে আসি। কিছুদিন বাদেই রাউল একটা চিঠি লিখে আমাকে আর্জেন্টিনায় যেতে নেমন্তন্ন করে। আমি দেশে তখন খুব ভাল অবস্থায় নেই। বরাবরই আমার একটু বড়লোক হওয়ার নেশা। তা ছাড়া বিশ্ববিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন তো ছিলই। হাজার ডলার সম্বল করে আমি আবার ভেসে পড়লাম। আর্জেন্টিনায় রাউলের সঙ্গে দেখা হল। সে-ই আমাকে পলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারপর থেকেই আমার জীবন অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। মেক্সিকোয় যে মিশনে রাউলের সঙ্গে আমাকে পাঠানো হয়েছিল সেটা ছিল বিপজ্জনক। কথা ছিল খুনের কাজটা আমিই করব। রাউল থাকবে আড়ালে। সে আমাকে পালাতে সাহায্য করবে। ফয়দাও ছিল আমারই বেশি। ওই একটা কাজের জন্যই আমাকে পাঁচ লাখ ডলার দেওয়ার কথা। হাতে-হাতে। মেক্সিকোর ৪৮
একটি হোটেলে টাকা নিয়ে অপেক্ষা করছিল ডলফিন নামে আর-একটা লোক। কাজ হাসিল করে গেলেই টাকা মিটিয়ে দেবে। কিন্তু ব্যাপারটা প্ল্যানমাফিক হল না। ওই পার্টিতে সাদা পোশাকে অনেক সিকিউরিটি গার্ড ছিল, যে-তথ্যটা আমাদের জানা ছিল না। আমাকে একটা ছোট্ট হাতবোমা দেওয়া হয়েছিল। একটা নৈনিতাল আলুর চেয়ে বেশি বড় নয়। কিন্তু খুব শক্তিশালী। কথা ছিল সবাই যখন সেই শিল্পপতির স্বাস্থ্যপান করবে সেই সময়ে বোমাটা টপকে দেওয়া। কেউ ধরতে পারত না আমাকে। বোমা ফাটলে সবাই বিভ্রান্ত হয়ে যেত।”