রকি অবাক হয়ে বলে, “সে কী! আমার যে নতুন চাকরি, অনেক দায়িত্ব, কোম্পানি ছাড়বে কেন?”
“ওরে, যা বলছি শোন। চাকরি যদি যায় তো যাবে। তোর যা কোয়ালিফিকেশন তাতে ফের ভাল চাকরি পাবি। প্রাণের চেয়ে তো আর চাকরিটা বেশি নয়।”
“প্রাণ! প্রাণের কথা উঠছে কেন কাকা?”
“আগে আয়, তারপর ডিটেল্স শুনবি। কিন্তু একটা মুহূর্তও দেরি করিস না। তোর সত্যিই বিপদ। ডেল্টার নাম শুনেছিস?”
“শুনেছি। ডেল্টা তো খুব ডেঞ্জারাস অর্গানাইজেশন!”
“তোর পিছনে ডেল্টা লেগে গেছে। ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য বললাম। চলে আয়।”
৪. পায়রাটা এল
পায়রাটা এল সকাল আটটা নাগাদ। বাবু মিত্তির তাঁর দোতলার বসবার ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। কিংবা পড়ার চেষ্টা করছিলেন। মন দিতে পারছিলেন না। আজকাল কোনও কিছুতেই মন দিতে পারেন না। বেজায় অন্যমনস্ক থাকেন। মনটা সবসময়ে কেবল ‘হায় হায়’ করে। অনেক টাকা করলেন, গাড়ি হল, বাড়ি হল, লোকে মান্যগণ্যও করে, কিন্তু সবই যেন ব্যর্থ হয়ে গেল নিজের স্বভাবদোষে। মৃত্যু চকিতে এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। ছেলেটার কোনও খোঁজ নেই। কালীপ্রসাদের ভৌতিক গল্পটা তাঁর পুরোপুরি বিশ্বাস হয় না বটে। তবু শেষ ভরসা হিসেবে নির্ভর করে আছেন। জঙ্গলে এক ভুতুড়ে গাঁয়ে বাস করে কালীপ্রসাদ, হয়তোবা সত্যিই সেখানে অলৌকিক কাণ্ডকারখানা হয়।
সর্বক্ষণ উৎকর্ণ থাকেন বলেই বোধ হয় পায়রার ডানার আওয়াজটা শুনতে পেলেন। তাড়াতাড়ি ছাদে উঠে এসে পায়রার পা থেকে চিরকুটটা পড়লেন। তাঁর বিছানায় রেডিয়ো-অ্যাকটিভ ছুঁচ আছে এটা কালীপুর গ্রামে বসে কালী প্রসাদ জানতে পারল কীভাবে?
বাবু মিত্তির তাড়াতাড়ি নেমে এসে শোওয়ার ঘরে ঢুকলেন। বিছানা পরিপাটি করে পাতা। ওপরে টান-টান বেডকভার। তিনি আগে বেডকভারটা তুলে দেখলেন। সাদা ধবধবে চাঁদর পাতা। ইস্তিরির দাগ এখনও রয়েছে। তার অর্থ চাঁদরটা আজ সকালেই পাতা হয়েছে। একটু নিচু হয়ে খুব মন দিয়ে চাঁদরটা লক্ষ করলেন বাবু মিত্তির। ছুঁচ থাকলেও ওপর থেকে বোঝা যাবে না। তিনি খুব সাবধানে চাঁদরটা তুললেন। ছুঁচটা দেখতে পেলেন মিনিটদুয়েকের চেষ্টায়। তিনি শুলে তাঁর কোমর যেখানে থাকবার কথা ঠিক সেখানে খুব বুদ্ধি করে তোশকে সেলাইয়ের মধ্যে ছুঁচটা গোঁজা রয়েছে।
কলিংবেল দিয়ে রাখালকে ডাকলেন। “সকালে বিছানা কে তুলেছে রে রাখাল?”
“আমিই তুলেছি।”
রাখাল একটু অবাক হয়ে বলে। “সকালে তুই ছাড়া আর কেউ শোওয়ার ঘরে ঢুকেছিল?”
“জমাদার বাথরুম ধোলাই করতে ঢুকেছিল। আর পোকামারা বাবুরা এসে স্প্রে করে গেছে।”
“পোকামারা বাবু, মানে পেস্ট কন্ট্রোল?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, তারাই।”
“আজ কি তাদের আসার কথা?”
“তা তো জানি না। মাসে একবার করে তো আসে।”
“কখন এসেছিল?”
“আপনি তখন বাগানে পায়চারি করছিলেন।”
“সে তো খুব সকালে। অত সকালে পেস্ট কন্ট্রোলের লোকেরা আসে নাকি? তোর সন্দেহ হয়নি?”
“সন্দেহ হয়নি, তবে তারা নিজেরাই বলল, আজ অনেক বাড়িতে যেতে হবে বলে তারা সকালেই বেরিয়ে পড়েছে।”
“তুই তাদের সঙ্গে ছিলি?”
“ছিলাম।”
“কিছু অস্বাভাবিক দেখিসনি?”
“না। তবে পাম্পার ফিট করতে গিয়ে একজনের হাত একটু কেটে গিয়েছিল বলে অ্যান্টিসেপটিক এনে দিয়েছিলাম।”
“তারা ক’জন ছিল?”
“চারজন।”
“চেনা লাগল?”
“না। প্রতি মাসে এক লোক আসে না।”
“একটা চিমটে আর একটা টিনের কৌটো দিয়ে যা। আর পলাশকে পাঠিয়ে দে। সে কী করছে?”
“সকালের জলখাবার খাচ্ছে।”
“খাওয়া হলে আসতে বলিস।” রাখাল চিমটে আর কৌটো দিয়ে গেলে বাবু মিত্তির দরজা বন্ধ করে ছুঁচটা সাবধানে ধরে কৌটোয় পুরলেন। তারপর তোশকসমেত চাঁদর আর বেডকভারটা মুড়ে রাখলেন। ধীরেসুস্থে ব্যবস্থা করতে হবে। নিজেকেই।
পলাশ যখন এল তখন কাজ শেষ করে তিনি বসবার ঘরে এসে বসেছেন।
পলাশ বলল, “ডাকছিলেন আমাকে?”
“হ্যাঁ। তুমি কি সায়েন্সের ছাত্র?”
“বি. এসসি. পাশ করেছিলাম।”
“রেডিয়ো অ্যাকটিভ কোনও জিনিসের সংস্পর্শে এলে কী হয় জানো?”
“ক্যানসার হয় বলে শুনেছি। কেন বলুন তো?”
“ঠিক জানো?”
“যদি বলেন তো ভাল করে খোঁজ নিয়ে বলতে পারি।”
“ভাল করেই খোঁজ নাও।”
“নেব।”
“আর-একটা কথা, যদি ক্যানসার হয় তবে কতদিনে সেটা বোঝা যাবে। সেটাও জেনে এসো।”
“হঠাৎ এসব বলছেন কেন?”
বাবু মিত্তির পলাশের দিকে তাকালেন। কালীপ্রসাদ তাঁকে যতদূর সম্ভব গোপনীয়তা রক্ষা করতে বলেছেন। সুতরাং ঘটনাটা একে বলা ঠিক হবে না। তিনি বললেন, “কাল তোমাকে বলব। আর-একটা কথা, আমাকে এখন সবসময়ে পাহারা দেওয়ার দরকার নেই।”
“কেন বলুন তো?”
“মনে হচ্ছে দরকার হবে না।”
“রাখাল বলছিল আপনার বিছানায় কিছু একটা হয়েছে। কাঁকড়াবিছে বা সাপটাপ গোছের কিছু? সকালে নাকি পেস্ট কন্ট্রোলের লোক এসেছিল, যাদের আপনি সন্দেহ করছেন?”
বাবু মিত্তির মুখটা নিরাসক্ত রাখবার প্রাণপণ চেষ্টা করে বললেন, “মেক্সিকোর কুখ্যাত কালো কাঁকড়াবিছে। আমি সেটাকে মেরে ফেলে দিয়েছি।”
পলাশ একটু বিবর্ণ হয়ে বলল, “ক’টা ছেড়ে গেছে তার ঠিক কী?”
“ভাল করে খুঁজে দেখেছি। ও-ঘরটা আজ অ্যাভয়েড করলেই হবে। রাম পহলওয়ানের খবর নিয়েছ?”
“নিয়েছি। পেট থেকে পাম্প করে বিষ বের করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থা এখনও ভাল নয়। বাহাত্তর ঘণ্টা না কাটলে কিছু বলা যাবে না।”