কালীপ্রসাদ সাহসী মানুষ। তবু একটু বিহ্বল বোধ করতে লাগলেন। এরকম অভিজ্ঞতা তাঁর নতুন। তিনি ঘরে এসে তাঁর মোটা লাঠিগাছটা নিয়ে একতলায় নেমে এলেন। এ-অঞ্চলে এমন কোনও চোর নেই, যে কিনা তাঁর বাড়িতে হানা দেওয়ার সাহস রাখে। কালী প্রসাদকে সবাই
ভয় খায়। তবে আজ কোন চোরের এমন বুকের পাটা দেখা দিল?
তিনি পায়ের শব্দ না করে ল্যাবরেটরির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। দরজা ভেজানোই থাকে। তালা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। কারণ, একতলার সদর দরজা বন্ধ থাকলে কেউ ঢুকতে পারে না। বাইরে থেকে কান পেতে ভেতরে কোনও শব্দ হচ্ছে কিনা শোনার চেষ্টা করছিলেন তিনি। এমন সময়ে কে যেন তাঁর কাঁধে খুব মৃদু একটা চাপড় দিল।
কালীপ্রসাদ চমকে ফিরে তাকালেন। কেউ নেই। একটু হতভম্ব বোধ করলেন তিনি।স্পষ্ট টের পেয়েছেন, কাঁধে কেউ চাপড় দিয়েছে! লোকটা কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল? কালীপ্রসাদ শরীরে একটা শীতল শিহরন অনুভব করেও লজিক হারালেন না। এমনও হতে পারে একটা চামচিকে উড়তে-উড়তে তাঁর পিঠে পাখার ঝাঁপটা দিয়েছে। ব্যাখ্যাটা খুব মনঃপূত হল না তাঁর, তবু লজিক্যাল বলে মনে হল।
ল্যাবরেটরির মধ্যে কোনও শব্দ ছিল না। কিন্তু হঠাৎ খুব ক্ষীণ একটা কাঁচের শব্দ শুনে কালীপ্রসাদের দৃঢ় ধারণা হল, ল্যাবরেটরিতে চোর বা আগন্তুক কেউ ঢুকে পড়েছে। তিনি দরজাটা আস্তে করে খুলে ভেতরে ঢুকলেন।
ঘর নিরেট অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কাঁচের পাত্র নাড়াচাড়ার একটা ক্ষীণ শব্দ শুনেছিলেন, এখন অবশ্য কোনও শব্দ নেই। কালীপ্রসাদ টর্চ জ্বেলে দেখলেন, তারপর ইনভার্টার চালু করে আলো জ্বেলে তন্ন-তন্ন করে খুঁজলেন। কেউ কোথাও নেই। চিন্তান্বিত কালী প্রসাদ আলো নিভিয়ে যখন ল্যাবরেটরি থেকে বেরোতে যাবেন, ঠিক তখনই কে যেন আবার তাঁর পিঠে খুব আলতো করে একটা চাপড় দিল। কালীপ্রসাদ আবার চমকে উঠলেন। টর্চ জ্বেলে, বাতি জ্বেলে ফের দেখলেন। কেউ কোথাও নেই।
চামচিকেই হবে, ভেবে নিয়ে কালীপ্রসাদ দরদালানে বেরিয়ে এসে যখন দোতলায় উঠতে যাবেন তখন আর চাপড় নয়, কে যেন তাঁর কাঁধে আলতো করে হাত রাখল। কালীপ্রসাদ হাতটা ধরার জন্য একটা থারা দিলেন। হাতটা সরে গেল।
বাদা অঞ্চলের অজ পাড়াগাঁয়ে তাঁর জন্ম, বাঘ অবধি পুষেছেন, অসমসাহসী কালীপ্রসাদ ভয় কাকে বলে তা জানতেনই না। কিন্তু এখন হঠাৎ ভয় যেন বাঘের মতোই সাপটে ধরল তাঁকে। শরীরটা কেমন ঠাণ্ডা আর শক্ত হয়ে যেতে লাগল। ভেতরে একটা কাঁপুনি। মাথাটা ঝিমঝিম। তাঁর দু’জন কাজের লোক তিনতলার ছাদে দুখানা ঘরে থাকে। তাদের ডাকার মতো ক্ষমতাই নেই কালী প্রসাদের। এমনকী সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় অবধি উঠতে পারছেন না। শরীরটা যেন সাতমন ভারী হয়ে গেছে। এই অবস্থাকেই কি স্তম্ভন বলে? নাকি তাঁর স্ট্রোক হয়ে গেল? মাথায় কোনও গণ্ডগোল হয়ে যায়নি তো!
সিঁড়ির গোড়ায় কালীপ্রসাদ অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। এক পাও নড়তে পারলেন না। হঠাৎ টের পেলেন, তাঁর কানের কাছে অনেক মশা যেন পিনপিন শব্দ করে উড়ে বেড়াচ্ছে। এত মশা কোথা থেকে এল তা বুঝতে পারলেন না। চাষবাসে পোকা মারার ওষুধ দেওয়ার ফলে আজকাল আর এ-অঞ্চলে মশা বিশেষ নেই। তার ওপর কালী প্রসাদের বাড়িতে রোজ রিপেলেন্ট স্প্রে করা হয়।
হঠাৎ কালীপ্রসাদের মনে হল, মশা বলে যাদের ভাবছেন তারা মশা নয় হয়তো। কারণ পিনপিন শব্দটা একটু অন্যরকম। কালীপ্রসাদ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে মনোযোগ দিয়ে শব্দটা শুনবার চেষ্টা করলেন। খানিকক্ষণ চোখ বুজে প্রায় ধ্যানস্থ থাকার পর তিনি বুঝতে পারলেন, মশার শব্দ বলে যা মনে হয়েছিল আসলে তা খুব চিকন, খুব মিহি, খুব মৃদু একটা গলার স্বর। এই অপ্রাকৃত ঘটনায় তাঁর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তবু প্রাণপণে নিজেকে সংযত রাখলেন। ভাবলেন, যা হওয়ার হবে।
চোখ বুজে ফের ধ্যানস্থ হয়ে গলার স্বরটাকে শোনার ও বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন কালী প্রসাদ। দোতারা বা ওই ধরনের তারের যন্ত্রের মতো স্বরটা প্রথমে সঙ্কেতধ্বনি বলে মনে হচ্ছিল। তারপর একটা-দুটো শব্দ ওর মধ্যেই বুঝতে পারলেন। কে যেন বলছে, তুমি মিথ্যাচারী! তুমি মিথ্যাচারী!
কালীপ্রসাদ অস্ফুট গলায় বললেন, “আপনি কে?”
“তারাপ্রসাদ।”
কালীপ্রসাদ সভয়ে বললেন, “আমার প্রণাম। আমি কী অপরাধ করেছি?”
“বন্ধুর কাছে পূর্বপুরুষের মিথ্যে গল্প বলেছ।”
“বন্ধুকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলেছি। ক্ষমা করুন।”
“তোমার ঠাকুদার আত্মার অপমান হয়েছে।”
“অপরাধ হয়েছে। আর করব না।”
“তুমি অকৃতজ্ঞ। তুমি জানো যে, তোমার পূর্বপুরুষেরা সর্বদাই তোমাকে ঘিরে থাকেন! সর্বদাই তোমার মঙ্গলের জন্য চেষ্টা করেন!”
“আজ্ঞে, জানতাম না।”
“তোমার বন্ধু পাপী লোক। তার কর্মফল ফলবেই। তুমি ওর মধ্যে যাবে না।”
“যে আজ্ঞে। কিন্তু তার ছেলেটা যে ভাল।”
“বাবু মিত্র অপঘাতে মরবে। দিন ঘনিয়ে আসছে।” কালীপ্রসাদ শিহরিত হলেন। বাবু মিত্তিরের অতীতের কিছুটা যে ভাল নয় তা তিনি জানেন। কিন্তু বন্ধুর প্রতি তাঁর একটা গভীর ভালবাসাও আছে। করুণ স্বরে বললেন, “তাঁকে বাঁচানোর কি কোনও উপায় নেই?”
“তুমি তাকে বাঁচাতে চাও?”
“চাই।”
“তা হলে একেবারে চুপ করে থাকো, তার উপকার করতে গেলে অপকারই হবে। মিথ্যাচার করে বংশে কালি দিয়ো না।”