চাক্ষুষ করার আগ্রহ বাড়াতে বাড়াতে একদিন হঠাৎ বন্ধ ঘরের মধ্যে মোমবাতির শিখাটা কেমন যেন এঁকেবেঁকে লতিয়ে উঠতে লাগল। তারপর নিভে গেল। আমি চুপ করে শ্বাস বন্ধ করে বসে রইলাম। মনে হচ্ছিল, ঘরে আমি একা নই। আরও কেউ একজন আছে। ভয় বলে আমার কিছুই নেই। তবে একটা দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, যা অনুভব করছি তা সত্য কি না। খানিকক্ষণ পর হঠাৎ খুব ক্ষীণ একটা ফিসফিসানি শুনতে পেলাম, ‘আমি তোমার দাদু শিবপ্রসাদ। কী জানতে চাও বলো! আমি ভয় পাইনি, তবু কেমন যেন শরীরটায় ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। আমার নিজের অনেক কিছু জানার আছে। তাই প্রথমেই জিজ্ঞেস করলাম, পৃথিবীতে বিকল্প শক্তির আবিষ্কার সম্ভব হবে কি না।’ দাদু জবাব দিলেন, “আমি সবজান্তা নই। আরও কয়েকটা প্রশ্ন করে বুঝলাম, দাদু জবাব দিতে চাইছেন না। তখন প্রশ্ন করলাম, আমার বন্ধু বাবু মিত্তিরের নিরুদ্দেশ ছেলে রকি কি বেঁচে আছে? দাদু এবার কিন্তু বেশ জোর গলায় বললেন, ‘আছে।’ শুনে খুব একটা আনন্দ হল। বললাম, ‘কোথায় এবং কেমন আছে? দাদু বললেন, ‘বেশি বলা সম্ভব নয়। তবে ভাল আছে।”
বাবু মিত্তির ঘটনাটা শুনতে-শুনতে কেমন যেন লাল হয়ে গেলেন। তারপর হঠাৎ উঠে দ্রুতবেগে পায়চারি করতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে হাঁফাতে লাগলেন। সবাঙ্গ ঘামে ভেজা।
কালীপ্রসাদ বন্ধুর অবস্থা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। ছেলের জন্য নীরবে গোপনে দুশ্চিন্তা করতে করতে বাবু যে নিজের জীবনীশক্তিকে নিংড়ে দিয়েছেন, তা খুব গভীরভাবে বুঝতে পারলেন কালী প্রসাদ।
বাবু মিত্তির স্বাভাবিক হতে অনেক সময় নিলেন। তারপর ফ্যাঁসফ্যাঁসে হাঁফধরা গলায় বললেন, “কালীপ্রসাদ, তুই যা বলছিস তা যে সত্যি তা আমাকে ছুঁয়ে বল।”
কালীপ্রসাদ নির্দ্বিধায় বন্ধুর হাত স্পর্শ করে বললেন, “তোর ছেলে যে বেঁচে আছে তাতে আমার কোনও সন্দেহ নেই।”
“আমি তার খবর চাই।”
“খবর পেলেই আমি তোকে জানাব, দাদুর সঙ্গে আমি আবার কথা বলবার চেষ্টা করব।”
“তুই থাকিস সুন্দরবনে, দুর্গম জায়গায়। আমি খবর পাব কী করে?”
কালীপ্রসাদ হাসলেন, বললেন, “সেইজন্যই আমার পায়রা-দূত নিয়ে এসেছি। তুইও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবি, আমিও পারব।”
বাবু মিত্তিরকে রকির খবরটা পুরো জানাতে কেন যেন ইচ্ছে হল না তাঁর। কেন যেন মনে একটা বাধা অনুভব করছিলেন কালীপ্রসাদ। তাড়া নেই, খবরটা দু-চারদিন পরে দিলেও হবে।
কলকাতা থেকেই তিনি আমেদাবাদে ট্রাঙ্ককল করে রকিকে সব জানিয়ে বললেন, “ভূতের গল্প বানিয়ে বলতে হয়েছে। সাধারণভাবে বাবুর পক্ষে গল্পটা বিশ্বাস করা সম্ভব হত না। কিন্তু এখন মানসিক অবস্থা এত খারাপ যে, বিশ্বাস করেছে।”
রকি করুণ গলায় বলল, “বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কালীকাকা।”
“কষ্ট হোক, তবু দুম করে ফোনটোন করে বসিস না যেন। ও তোর গলা শুনলে না হার্টফেল করে। ক’দিন একটু সয়ে যাক। সময় বুঝে আমি যা করার করব।”
কালীপ্রসাদ গাঁয়ে ফিরে এলেন। আর এসেই পড়লেন মুশকিলে।
কালীপ্রসাদ বিজ্ঞানী মানুষ। ভূতের গল্প বানিয়ে বললেও তাঁর বাস্তবিক ভূতে কোনও বিশ্বাস নেই। ওসব নিয়ে চিন্তাভাবনাও করেননি কখনও। থাকেন নিজের কাজ নিয়ে। বিশাল বাড়ির একতলার হলঘরে ল্যাবরেটরি। সেখানেই তাঁর দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে। নানারকম রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া, পাথর, ধাতু, গাছ-গাছড়া সবকিছু নিয়েই তিনি কাজ করেন। প্রতিদিনকার কাজের নোট রাখে। এসব নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে, অন্য কিছু নিয়ে ভাববার অবকাশই তাঁর নেই।
কিন্তু যেদিন বাবু মিত্তিরকে ভূতের গল্প শুনিয়ে গাঁয়ে ফিরে এলেন সেই রাতেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।
অনেক রাতে ল্যাবরেটরির কাজ শেষ করে যখন ওপরে দোতলায় শোওয়ার ঘরে ঘুমোতে এলেন, তখন কালীপুর এক শব্দহীন ঘুমের পুরী। বেশ শীত পড়েছে। চারদিকে ঘন কুয়াশা। শিশির পড়ার টুপটাপ শব্দ হচ্ছে।
ঘরের দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে লেপের তলায় ঢুকবার পরই তাঁর হঠাৎ মনে হল, ঘরে তিনি একা নন। আর কেউ আছে। কোনও শব্দ হয়নি বা কিছু চোখেও পড়েনি। তবু মনে হল। তিনি টর্চ জ্বেলে ঘরটা দেখলেন। কেউ কোথাও নেই। খাটের তলাও ফাঁকা। তবে কি মনের ভুল? তাই হবে। কালীপ্রসাদ চোখ বুজলেন। কিন্তু কেমন একটা অস্বস্তি হতেই লাগল।
একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ হল কি? কালীপ্রসাদ উঠে বসলেন। হাতে টর্চ। মৃদুস্বরে বললেন, “কে?”
কেউ জবাব দিল না। কিন্তু দেওয়ালঘড়িতে টং করে একটা শব্দ হল। রাত একটা বাজে কি? নাকি সাড়ে বারোটা? নাকি দেড়টা? ঘড়ি দেখে চলার অভ্যাসই নেই কালী প্রসাদের। বাদা অঞ্চলের গাঁয়ে ঘড়ি ধরে চলার কোনও কারণও তো নেই। কালী প্রসাদ কদাচিৎ ঘড়ির দিকে তাকান। সময়টা তাই ধরতে পারলেন না। খাট থেকে নেমে চারদিকটা তন্ন-তন্ন করে দেখলেন টর্চ জ্বেলে। কোথাও কেউ নেই।
বারান্দায় এসে দেখলেন, বাইরে কুয়াশায় মাখা জ্যোৎস্নায় বনে-জঙ্গলে যেন এক অপ্রাকৃত কিছুর সঞ্চার হয়েছে। এ যেন চেনা কালীপুর নয়। স্বপ্নে দেখা কোনও জায়গা।
সিঁড়ি দিয়ে একটা অস্পষ্ট পায়ের শব্দ নেমে যাচ্ছে কি? কালীপ্রসাদ তাড়াতাড়ি গিয়ে সিঁড়ির মুখ থেকে নীচে আলো ফেললেন। কাউকে দেখা গেল না। কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পেলেন একজোড়া ভারী চটির শব্দ যেন সন্তর্পণে নীচে নেমে একতলার দরদালান দিয়ে ল্যাবরেটরির দিকে যাচ্ছে।