- বইয়ের নামঃ সোনার মেডেল
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. বিকেলের দিকে বাবু মিত্তির
সোনার মেডেল – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
বিকেলের দিকে বাবু মিত্তির চিঠিটা পেলেন। তাঁর দরোয়ান রাম পহলওয়ান এই সময়টায় রোজ তাঁকে এক গেলাস ঘোলের নোনতা শরবত খাওয়ায়। শরবতের সঙ্গে চিঠিটাও সে দিয়ে গিয়েছিল।
বাবু মিত্তির সব কাজই নিখুঁতভাবে করতে ভালবাসেন। সাবধানে ছোট কাঁচি দিয়ে খামের মুখটা কেটে চিঠিটা বের করলেন। দামি সাদা কাগজে টাইপ করা রোমান হরফে গীতার একটা শ্লোকের খণ্ডাংশ, “বাসাংসি জীণানি যথা বিহায়–ডেল্টা।“
শরবতটা আর খাওয়া হল না। তিনি উঠলেন। বাবু মিত্তির আজকাল সব কাজই করেন খুব ধীর গতিতে। খেতে, পোশাক পরতে, চলাফেরা করতে তাঁর অনেকটা সময় লাগে। কেউ বিশ্বাসই করবে না যৌবনকালে এই বাবু মিত্তিরের চলাফেরা ছিল বাঘের মতো, বিদ্যুতের মতো, সাপের মতো। সাহেবরা তাঁর নামই দিয়েছিল কোব্রা।’
বক্সার বাবু মিত্তির অলিম্পিকে গিয়েছিলেন। লাইট হেভিওয়েটে সোনার মেডেলটা জেতার দুর্দমনীয় বাসনা ছিল। প্রথম তিন লড়াইতে প্রতিটিতে তাঁর প্রতিপক্ষ এক বা দুই রাউন্ডে নক আউট হয়ে যায়। চার নম্বর লড়াইয়ের আগে পেটের অসহ্য যন্ত্রণায় তিনি রিং-এ নামতে পারেননি। নামতে পারলে, ভারতের দীর্ঘদিনের একটা বদনাম ঘুচত।
কিন্তু পেটের ব্যথাটা কেন হয়েছিল সে বিষয়ে বাবু মিত্তির খুব নিশ্চিত নন। সাবোটাজ? ষড়যন্ত্র? এ ছাড়া আর কীই বা হবে? অলিম্পিক ভিলেজে ভারতীয় শিবিরে তাঁর তেমন শত্ৰু কি কেউ ছিল? বোধ হয় না। তবে এ-কথা ঠিক যে, ভাল ব্যবহারের জন্য বাবু মিত্তিরের মোটেই সুনাম ছিল না। রাগী, রগচটা, মারকুট্টা, স্পষ্টবক্তা, দুর্মুখ বাবু মিত্তিরকে কেউ পছন্দ করত না, সবাই এড়িয়ে চলত। কিন্তু তা বলে খাবারে গণ্ডগোল ঘটাবে এমন কেউ ছিল না। রহস্যটা আজও বাবু মিত্তিরের কাছে রহস্যই থেকে গেল। অলিম্পিক ভিলেজে খেলোয়াড়দের খাবারদাবারের ব্যাপারে খুবই সতর্কতা থাকে। তবু কী করে যেন বাবু মিত্তিরের খাবারে মৃদু কোনও বিষ মেশানো হয়েছিল। কোন খাবারটিতে বিষটা ছিল, তা তিনি জানেন না, অনেক ভেবেছেন।
বাবু মিত্তির খুব ধীরে-ধীরে পোশাক পরলেন। আজকাল ধুতি আর কামিজ ছাড়া বিশেষ কোনও পোশাকই নেই তাঁর। পোশাক পরে পায়ে চটিটা গলিয়ে ধীরে-ধীরে দোতলা থেকে নেমে গ্যারাজ থেকে পুরনো অস্টিন গাড়িটা বের করলেন। গাড়ি আজও তিনি নিজেই চালান।
গাড়ি ছাড়বার আগে একবার নিজের বাড়িটার দিকে ফিরে চাইলেন তিনি। প্রকাণ্ড তিনতলা বাড়ি। অন্তত পনেরোটা শোওয়ার ঘর, দুটি বৈঠকখানা, একটা নাচঘর, দুটো ডাইনিং হল আছে। বাবু মিত্তির মারা গেলে এ বাড়ি বেওয়ারিশ হয়ে যাবে। তাঁর কোনও উত্তরাধিকারী নেই, থাকলেও যে কোথায় আছে তা তিনি জানেন না।
মরবার যে আর খুব বেশি দেরি নেই, তা বাবু মিত্তির জানেন। যে-চিঠিটা তিনি এইমাত্র পেলেন, সেটি ফাঁকা তাওয়াজ বা রসিকতা নয়।
যৌবনকালে বড়ই দুর্দান্ত মানুষ ছিলেন তিনি। প্রচণ্ড গুণ্ডামি করে বেড়াতেন। খুন না করলেও জখম করেছেন বিস্তর। সাহস ছিল, প্রচণ্ড রাগ ছিল। কিন্তু একটা গণ্ডগোলে পড়ে গিয়েছিলেন একবার। মুষ্টিযুদ্ধ ছেড়ে তখন তিনি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু পৃথিবী-ভ্রমণের জন্য যথেষ্ট টাকা বা বিদেশি মুদ্রা তাঁর ছিল না। খুব কষ্ট করে এবং আইন ও আন্তজাতিক নিয়মকানুনকে ফাঁকি দিয়েও তিনি দেশে-দেশে ঘুরতেন।
আর্জেন্টিনায় সেবার একটা লোকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়ে যায়। বাবু মিত্তিরের চমৎকার পেটানো চেহারা, তেজ ও সাহস দেখে সেই লোকটা বলে, তোমাকে উপযুক্ত কাজ দিতে পারি। যথেষ্ট টাকা পাবে। কিন্তু খুব সাবধান, বেইমানি কোরো না।
অর্থাভাব এবং অনিশ্চয়তায় জেরবার বাবু মিত্তির লোকটার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। সেই লোকটাই ছিল ডেল্টা নামে ছোট একটি টেররিস্ট সংগঠনের নায়ক। তবে তাদের কোনও বিশেষ মতাদর্শ ছিল না। টাকা পেলে তারা নেতা, ভি আই পি বা বাণিজ্যিক সংস্থার কর্ণধারদের খুন করত। সোনা, অস্ত্র, নেশার জিনিস চোরাপথে চালান দিত।
এই সংগঠনে বছরখানেক ছিলেন বাবু মিত্তির। ওই এক বছরে গোটা দক্ষিণ আমেরিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ চষে বেড়িয়েছেন ডেল্টার বিভিন্ন কাজে। প্রচুর টাকাও পেয়েছিলেন। কিন্তু মেক্সিকোর এক অভিজাত নৈশভোজের নাচের আসরে একজন ইউরোপিয়ান শিল্পপতিকে খুন করার চুক্তি কার্যকর করতে গিয়ে বাবু মিত্তিরের সঙ্গী রাউল নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে মারা যায়, এবং বাবু মিত্তির পালান।
পালানোর একটা সুযোগ কিছুদিন যাবৎ খুঁজছিলেন তিনি। ডেল্টার হয়ে কয়েকটা খুনের ঘটনায় তাঁকে অংশ নিতে হয়েছে। সমাজবিরোধী আরও নানা পাপ কাজ করতে হচ্ছে। এ-জীবন ঠিক তাঁর পছন্দ হচ্ছে বা। তিনি ভেবেছিলেন, কলকাতায় চলে গেলে ডেল্টা আর কিছু করতে পারবে না। অত লম্বা হাত বা বড় সংগঠন তাদের নেই যে, ভারতবর্ষে ধাওয়া করবে।
প্রচুর বিদেশি টাকা নিয়ে প্রথম আফ্রিকায় আর তারপর সোজা কলকাতায় চলে আসেন তিনি। বিশ্বভ্রমণের সাধ তখন মিটে গেছে।