গদাইবাবু মিস্তিরি ডাকিয়ে ছাদের দরজাটা আরও মজবুত করলেন তো বটেই, একটা কোলাপসিবল গেটও বসিয়ে দিলেন। আরও সতর্কতার জন্য একটা কুকুরও নিয়ে এলেন কিনে। বাচ্চা অ্যালসেশিয়ান, তবে বেশ চালাক-চতুর।
সেই রাতেই ফের চোর এল এবং বিশেষ গভীর রাতেও নয়। রাত বারোটা নাগাদ প্রথম কুকুরটা ঘেউ-ঘেউ করে তেড়ে গেল সিঁড়ি দিয়ে ছাদের দিকে। তারপর ছাদে শব্দও পাওয়া গেল। ঠিক পায়ের শব্দ নয়। অনেকটা যেন কিছু গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ।
গদাইবাবু সাহসী লোক। তিনি কারও বারণ না শুনে টর্চ আর পিস্তল নিয়ে ছাদে উঠলেন। কোথাও কিছু দেখা গেল না। চিলেকোঠার তালা খুলে দেখলেন, সবই ঠিক আছে। এমনকী, কুলুঙ্গিতে পানচো অবধি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ফিরে এসে গদাইবাবু বললেন, “ও আমাদের শোনার ভুল।” গিন্নি বললেন, “আমাদের ভুল হতে পারে, কিন্তু কুকুরের ভুল হয়
গদাইবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “কুকুর যতই চালাক হোক, সে মানুষের চেয়ে ইতর প্রাণী। মানুষের যদি ভুল হতে পারে কুকুরের হতে বাধা কোথায়?”
এই নিয়ে একটা তকাতর্কি হল বটে, কিন্তু রহস্যটার সমাধান হল না।
গদাইবাবুর টমটম ছাড়াও আরও তিন ছেলেমেয়ে। সবচেয়ে ছোটটি মেয়ে, বয়স মাত্র সাত মাস। সেদিন গদাইবাবু অফিসে আর ছেলেমেয়েরা যে যার স্কুলে গেছে। ঘোট মেয়েকে বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে গদাই-গিন্নি রান্নাঘরে ব্যস্ত রয়েছেন। বাচ্চা কাজের মেয়ে বকুল গিন্নিমার সঙ্গে টুকটাক কাজ করছে। এমন সময়ে বাচ্চাটা কেঁদে উঠল।
মেয়েটা পাছে গড়িয়ে খাট থেকে পড়ে যায় সেজন্য মোটা পাশবালিশ দেওয়া আছে দু দিকে। তা ছাড়া মশারিও আছে। মেয়ে কাঁদছে শুনে গদাই-গিন্নি তাড়াতাড়ি হাতের কাজ সারছিলেন। সারতে সারতেই শুনতে পেলেন কান্না থামিয়ে মেয়ে যেন কার সঙ্গে ‘অ অ করে খুব কথা বলছে। হাসছেও।
ঘরে এসে যা দেখেন তাতে তাঁর চক্ষুস্থির। মেঝের ওপর মাদুর পাতা, তার ওপর মেয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। চারদিকে পুতুল বল খেলনাগাড়ি সাজানো। মেয়েকে বিছানা থেকে কে নামাল, কে মাদুর পাতল, কে খেলনা নামিয়ে দিল তা বুঝতে না পেরে বিস্ময়ে তিনি হাঁ হয়ে রইলেন।
বাড়িতে কোনও লোক নেই, তিনি আর বকুল ছাড়া। তবু তন্ন-তন্ন করে খুঁজে দেখলেন।
গদাইবাবু বাড়ি ফিরলে গিন্নি হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠে বললেন, “বাড়িতে ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে।”
গদাইবাবু সব শুনে বললেন, “চোরের পর তোমার মাথায় আবার ভূতের বায়ু চাপল? আরে, এ হচ্ছে বিজ্ঞানের যুগ। ভূত-টুত এ-যুগে অচল। ওসব নয়। পাড়া-প্রতিবেশীদের কেউ চুপি-চুপি এসে একাণ্ড করে গেছে, তোমাকে একটু বোকা বানানোর জন্য।”
“অসম্ভব। সদর-দরজা আমি নিজে হাতে ডবল ছিটকিনি দিয়ে বন্ধ করেছিলাম। খিড়কির দোরেও হুড়কো দেওয়া ছিল।”
গাইবাবু আর বিজ্ঞান কপচানোর সাহস পেলেন না। তবে ঘটনাটা নিয়ে মাথা ঘামালেন না তেমন।
সন্ধেবেলা রোজকার মতো ছেলেকে নিয়ে তিনি ল্যাবরেটরিতে এলেন এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য। আজ তিনি ভ্যানিশিং ক্রিম, শ্যাম্পু আর কলিং বেল তৈরি করে সবাইকে অবাক করে দেবেন বলে জিনিসপত্র সব সাজিয়েই রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু ল্যাবরেটরিতে ঢুকে খুব তাজ্জব হয়ে দেখলেন, কে বা কারা ইতিমধ্যেই এসে ভ্যানিশিং ক্রিম, শ্যাম্পু এবং কলিং বেল তৈরি করে রেখে গেছে। আর জিনিসগুলো হয়েছেও বেশ উঁচু মানের।
“এ কী রে টমটম, এসব করল কে! তুই নাকি?”
টমটমও ভীষণ অবাক। মাথা নেড়ে বলল, “না তো বাবা। স্কুল থেকে এসে আমি ত ক্রিকেট খেলছিলাম। একটু আগে ফিরেছি।”
“তা হলে ল্যাবরেটরিতে কে ঢুকেছিল তালা খুলে?”
বেশ চিন্তিতভাবে গদাইবাবু আর টমটম বসে ছিল, এমন সময় বকুল এসে খবর দিল, পাড়ার দু’জন তোক দেখা করতে এসেছে।
গদাইবাবু নীচে নেমে এসে দেখেন পাশের বাড়ির গগন রায় আর আর-একজন প্রতিবেশী কানু বোস।
গগনবাবু বললেন, “তা ভায়া, তুমি তো বেশ দিব্যি একটা জেনারেটর কিনেছ। পাড়ায় লোডশেডিং আর তোমার বাড়িতে সব ঘরে আলো ঝলমল করছে।”
গদাইবাবু হাঁ হয়ে বললেন, “লোডশেডিং! জেনারেটর! না তো, আমি তো জেনারেটর কিনিনি। একটা ইনভাটার ছিল, তা তারও ব্যাটারিটা কদিন আগে ডাউন হয়ে গেছে।”
গগনবাবু অবাক হয়ে বললেন, “তা হলে আলো-টালো জ্বলছে। কিসে?”
গদাইবাবু বাইরে উঁকি মেরে দেখলেন, বাস্তবিকই পাড়ায় লোড়শেডিং চলছে। কিন্তু তাঁর বাড়িতে ঝলমল করছে আলো। তিনি মাথা চলকে বললেন, “মনে হচ্ছে কোনও হট লাইনের সঙ্গে আমার বাড়ির একটা অ্যাকসিডেন্টাল কানেকশন হয়ে গেছে।”
মুখে গদাইবাবু যা-ই বলুন তাঁর মন সে কথা বলছে না।
প্রতিবেশীরা চলে যাওয়ার পর তিনি কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন।
বায়ু বেশ চড়ে যাওয়ায় রাত্তিরে ভাল ঘুম হল না গদাইবাবুর। বারবার এপাশ ওপাশ করতে লাগলেন। রাত তিনটের সময় হঠাৎ রান্নাঘরে একটা খুটখাট শব্দ পেয়ে তিনি ঝপ করে উঠে পড়লেন। হাতে টর্চ আর পিস্তল। পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে তিনি দেখলেন, আলো জ্বলছে। ভিতরে কেউ নেই। কিন্তু খুবই আশ্চর্যের বিষয়, এক কাপ গরম চা সাজানো রয়েছে।
গদাইবাবুর চোখের পলক পড়ছিল না। রাত জাগার ফলে তাঁর ভিতরে একটা চা খাওয়ার ইচ্ছে যে চাগাড় দিয়েছে তা এতক্ষণ তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি। চা দেখে বুঝলেন, এখন তাঁর এই জিনিসটিই সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল।