- বইয়ের নামঃ বক্সার রতন
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. রিং-এর পাশে দুটো লোক
বক্সার রতন – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
রিং-এর পাশে দুটো লোক পাশাপাশি বসে আছে। একজন বেঁটেখাটো, দুর্দান্ত স্বাস্থ্য, মুখে দাঁড়িগোফের জঙ্গল, মাথায় একটা নীল ক্যাপ, গায়ে ডোরাকাটা নীল সাদা টি শার্ট, পরনে ব্লু জীনস। অন্যজন লম্বা, ক্রিকেট খেলোয়াড়ের মতো ছিপছিপে, পরনে ধূসর রঙের সুট, গলায় টাই, মুখচোখ খুব ধারালো, দুজনেরই বয়স ত্রিশ বত্রিশের মধ্যে।
রতন রিং-এর ভিতর থেকে দুজনকে লক্ষ করল। লক্ষ করারই কথা। গত দু-তিন মাসে সে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ও ভারতের বাইরেও নানা আসরে বক্সিং-এ নেমেছে অন্তত পাঁচ ছ’বার। দিল্লি, বাঙ্গালোর, ভুবনেশ্বর, কলম্বো এবং এখন এই খপুর। সব জায়গাতেই সে রিং-এর ধারে এই দুজনকে লক্ষ করেছে। এমন হতে পারে যে, এই মানিকজোড় বক্সিং-এর সাংঘাতিক ভক্ত। তাই যেখানে বক্সিং-এর আসর বসে সেখানেই গিয়ে হাজির হয়।
কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। রতন দেখেছে, এই দুজন আসে
কেবল তারই লড়াই দেখতে। আগে বা পরে যে-সব লড়াই হয়, তাতে এই দুজনের টিকিও দেখতে পাওয়া যায় না। কেন এরা তাকেই নজরে রেখেছে, তা রতন জানে না, কিন্তু আজ সে বেশ একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
গ্লাভস পরানোর আগে রতনের হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা হচ্ছিল। পাশেই দাঁড়িয়ে পশ্চিমবাংলা দলের ম্যানেজার চিত্তব্রত দে।
রতন মুখ তুলে ডাকল, “চিত্তদা।”
“কিছু বলছ?”
রতন ইশারা করল। চিত্তব্ৰত কানটা রতনের মুখের কাছে এগিয়ে আনে।
রতন বলল, “তাকাবেন না। খুব আড়চোখে আমার ডানধারে প্রথম সারিতে দেখুন, দুজন লোক বসে আছে। একজনের মুখে দাড়ি গোঁফ, গায়ে ডোরাকাটা গেঞ্জি, অন্যজন স্যুটেড বুটেড। ওঁদের চেনেন?”
চিত্তব্ৰত সোজা হয়ে চারদিকটা খুব উপেক্ষার চোখে একবার দেখে নেয়। তারপর মৃদুস্বরে বলে, “না। কেন বলো তো?”
“কোথাও দেখেননি?”
“মনে পড়ছে না।”
“আমি ওদের প্রায় সব জায়গাতেই হাজির থাকতে দেখেছি।”
ঢং করে ঘন্টা বাজল। লড়াই শুরু হতে দেরি নেই। চিত্ত ব্যস্ত হয়ে বলল, “ওদের নিয়ে ভেবো না। কনসেনট্রেট অন দি ফাঁইট। সুব্বা কিন্তু সাংঘাতিক অপোজিশন।”
রতন তা জানে। গত এক বছর ধরে সে আজকের রাতের জন্য তৈরি হয়েছে তিল তিল করে। দিল্লি, বাঙ্গালোর বা কলোঘোর চেয়ে খঙ্গাপুরের এই লড়াইয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। আজ রাতে হয় রতন না-হয় তো সারভিসেসের সুব্বা লাইট
হেভিওয়েট জাতীয় চ্যামপিয়ন হবে। রতনের চেয়ে সুব্বার নাম-ডাক অনেক বেশি। সুব্বা অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছিল, খুব অল্পের জন্য ব্রোঞ্জ মেডেলটা পায়নি। তাও পয়েন্টে হেরে। সেই লড়াইতে যে জিতেছিল, সেই জাপানি বক্সারকে প্রথম দু রাউন্ডে মেরে পাটপাট করেছিল সুব্বা। সুতরাং আজকের লড়াইতে সুব্বাই হট ফেবারিট।
রতনের বয়স কম, অভিজ্ঞতা কম। তার সম্বল শুধু উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর দম। লড়ে সে খুবই ভাল। কিন্তু সুব্বার মতো উঁচু শ্রেণীর বক্সারের সঙ্গে তার তুলনা করবে কে? তাছাড়া সুব্বার সঙ্গে এর আগে লড়াইয়ের কোনো সুযোগও রতন পায়নি। সুতরাং আজ তার একটু নাভাস লাগছিল।
রেফারী রিং-এ। রতন ও সুব্বা এসে রিং-এ ঢুকল। তুমুল হাততালি ও হর্ষধ্বনি।
সুব্বার চেহারা ভারী সুন্দর। টকটকে ফর্সা রঙ। বেশ লম্বা। শরীরের পেশীগুলি চ্যাপটা এবং আট। ঘাড় দারুণ মজবুত। কিন্তু বক্সারের শ্রেষ্ঠত্ব শুধু চেহারায় তো বোঝা যায় না। সুব্বার দুটি হরিণচোখের পেছনে যে তীব্র অনুমানশক্তি, খর নজর এবং বুদ্ধি রয়েছে তা বাইরে থেকে টের পাওয়া দায়। তার ওপর সুব্বা অত্যন্ত দ্রুতবেগসম্পন্ন বক্সার। অকল্পনীয় ফুটওয়ার্ক। কেউ-কেউ তাকে আলির সঙ্গে তুলনা করে। লড়াই শুরু হওয়ার ঘন্টা পড়তেই রেফারি দুজনকে রিং-এর মাঝখানে ডাকলেন। মৃদুস্বরে পরস্পরের পরিচয় করিয়ে দিলেন সংক্ষেপে। দুজনে গ্লাভসবদ্ধ হাতে হাত ঠেকাল।
তারপরই যে যার নিজের কোণে সরে গেল।
লড়বার মুহূর্তে আবার একবার রতনের চোখ পড়ল রিং-এর পাশে বসা সেই দুটি লোকের দিকে। তারা রতনের দিকে
একবারও তাকাচ্ছিল না। রিং-এর ওপরে ঝুলন্ত আলোর দিকে খুব আনমনে চেয়ে ছিল। কিন্তু রতনের মনে হয়, ওরা তাকে খুব ভাল করেই লক্ষ করছে।
জিতবে কি হারবে তা রতন জানে না। তবে ঘুষি খেতে খেতে আর ঘুষি মারতে মারতে তার একধরনের নির্বিকার ভাব এসে গেছে। ভয়ডরের ব্যাপার নয়। অভ্যাস। কেবল আজকের লড়াইটা জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত লড়াই বলে এবং প্রতিপক্ষ সুব্বার মতো সাংঘাতিক বক্সার বলে একটু অস্বস্তি বোধ করছিল রতন। আজকে আর যে পাঁচটি লড়াই হয়ে গেছে তার মধ্যে মাত্র একটিতে ব্যানটাম ওয়েটে পশ্চিমবঙ্গের একজন প্রতিযোগী ছিল, মদন রায়। পাঞ্জাবের বীর সিং-এর কাছে সে পয়েন্টে হেরে গেছে। রতন আর মদন ছাড়া আর কোনো বাঙালি বক্সার এবার ফাঁইনালে পৌঁছতে পারেনি। মদন হেরে গেছে, রতনও হারবে বলেই সবাই ধরে নিয়েছে। আর সেইটিই রতনের সবচেয়ে সুবিধে, সে হারলেও লজ্জা নেই। কেউ দুয়ো দেবে না। বরং যদি ভাল লড়ে হেরেও যায়, তবু সবাই প্রশংসা করবে।