গদাইবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “উঁহু, ওটা কাজের কথা নয়। বিজ্ঞানে তোমার আগ্রহ বাড়াতে হবে, বিজ্ঞানকে ভালবাসতে হবে। হাতে কলমে বিজ্ঞানচর্চা করলে আগ্রহ বাড়বে। দাঁড়াও। কালই বিজ্ঞানচর্চার জন্য জিনিসপত্র কিনে আনতে হবে।”
দুঃখের বিষয় গদাইবাবুও বিজ্ঞানের কিছুই জানেন না। বাড়িতে বিজ্ঞানচর্চা করতে হলে কী কী জিনিস লাগে এবং সেগুলো কোথা
থেকে পাওয়া যাবে তাও তিনি জানেন না। তবে সহজে দমবার পাত্র তিনি নন। ক্রমশ খোঁজ নিয়ে নিয়ে নানা দোকান ঘুরে তিনি জিনিসপত্র কিনতে লাগলেন।
মুর্গিহাটার একটা দোকানে দেখলেন সায়েন্স কিট বলে পলিথিনের সিল করা প্যাকেট রয়েছে।
“ওগুলো কী?”
দোকানদার মাথা নেড়ে বলে, “জানি না মশাই, এসব মাল হংকং থেকে আসে। কখনও খুলেও দেখি না। তবে শুনতে পাই ওর মধ্যে নানারকম পার্টস আছে। হাড় জুড়ে নানারকম জিনিস হয়। ব্যবহারবিধি ভিতরেই দেওয়া আছে।”
এক-একটা প্যাকেটের গায়ে এক-একটা নাম লেখা। জাম্পিং জো, ডুমস ডে, অটোমেটিক কার এইসব। একটা প্যাকেটের গায়ে লেখা মিস্টিরিয়াস মিস্টার পানচো।
দরদাম করে তিনি ‘পানচো’ লেখা প্যাকেটটা কিনে ফেললেন।
বাড়িতে এসে বাপ ব্যাটায় মিলে চিলেকোঠার ঘরটা সাফ করে ল্যাবরেটরি সাজিয়ে ফেললেন। বিজ্ঞানের মাস্টারমশাই হরবাবুকে ডেকে আনা হল। তিনি সব দেখেশুনে বললেন, “ভালই হয়েছে। আমিও মাঝে-মাঝেই এসে এক্সপেরিমেন্ট করতে পারব।”
ল্যাবরেটরি তৈরি হওয়ার পর সত্যিই টমটম আর গদাইবাবুর বিজ্ঞানে খুব মন হল। হরবাবু এসে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট দেখিয়ে দিয়ে যান, বাপ ব্যাটায় মিলে সেগুলো করে ফেলতে লাগলেন।
এইভাবে ক’দিনের মধ্যেই দু’জনে বিজ্ঞানের অনেককিছুই জেনে ফেললেন।
একদিন টমটম বলল, “বাবা, ওই প্যাকেটটা কিন্তু খোলাই হয়নি। টেবিলের তলায় পড়ে আছে।”
গদাইবাবু বললেন, “তাই তো। তা হলে আয় খুলে দেখা যাক।”
প্যাকেটটা বেশ বড়। ওজনও কম নয়। একটা স্ট্রিপ দিয়ে প্যাকেটের মুখ আটকানো।
প্যাকেট খুলে দেখা গেল, তাতে ছোট বড় নানারকম যন্ত্রাংশ রয়েছে। নির্দেশাবলীর একখানা ছাপা কাগজও রয়েছে সঙ্গে। তাতে লেখা, মিস্টিরিয়াস মিস্টার পানচো সম্পর্কে আমরা আগেভাগে কিছুই বলতে পারব না। সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে যাওয়ার পর মিস্টার পানচোকে দিয়ে কী কাজ হবে সে সম্পর্কেও আমরা নিশ্চিত নই। এটি সম্পূর্ণ পরীক্ষামূলক একটি যন্ত্র। এ দিয়ে ভালও হতে পারে, মন্দও হতে পারে।
কীভাবে মিস্টার পানচোকে তৈরি করা যাবে তার একটা ক্রম দেওয়া আছে।
যন্ত্রটি রহস্যময় বলেই গদাইবাবু এবং টমটম আরও উৎসাহ পেয়ে গেলেন।
সন্ধেবেলা যন্ত্রটা বানাতে বসবার কিছুক্ষণ পরই বোঝা গেল, যন্ত্রাংশগুলি খুবই জটিল। লাগানো বড় সোজা কথা নয়। সবচেয়ে বড় অংশটা একটা ব্যারেল বা পিপের মতো জিনিস। সেটা সিল করা। তার গায়ে নানারকম সকেট আর পয়েন্ট রয়েছে, যাতে
অন্যান্য জিনিস জোড়া হবে।
দুজনে মিলে ঘণ্টা-দুয়েকের চেষ্টায় মোটে তিন-চারটে জিনিস ঠিকমতো জুড়তে পারলেন। রাতের খাওয়ার ডাক আসায় কাজটা আর শেষ হল না।
পরদিন সকালে আবার বাপ-ব্যাটায় গিয়ে চিলেকোঠায় ঢুকলেন বাকি অংশগুলো জুড়তে। গিয়ে যা দেখলেন তাতে তাঁদের চক্ষুস্থির। যন্ত্রাংশগুলো কে যেন ইতিমধ্যেই জুড়ে দিয়েছে।
এটা কার কাজ তা বুঝতে না পেরে গদাইবাবু খুব রেগে গেলেন এবং বাড়ির অন্যান্য লোকদের বকাবকি করলেন। কিন্তু কে লাগিয়েছে তা ধরা গেল না।
টমটম অবশ্য নির্দেশ মিলিয়ে দেখে বলল, “বাবা, পার্টসগুলো কিন্তু ঠিক-ঠিকই লাগানো হয়েছে। যে-ই লাগাক সে আনাড়ির মতো কাজ করেনি।”
একথা শুনে গদাইবাবু একটু ঠাণ্ডা হলেন। তারপর জিনিসটা দেখতে লাগলেন।
মিস্টিরিয়াস মিস্টার পানচো এককথায় একটি বিতিকিচ্ছিরি চেহারার জিনিস। ব্যারেল বা ঢোলটাই হল তার ধড়। দু’খানা হাতের মতো জিনিস আছে, দু’খানা পায়ের মতোও জিনিস আছে, চাকাও আছে, একটি লেজ আছে। তবে মাথা নেই, তার বদলে একটা ডিসক অ্যান্টেনার মতো জিনিস লাগানো। সব মিলিয়ে বিদঘুঁটে।
গদাইবাবু যন্ত্রটার নানা অংশ নেড়েচেড়ে দেখলেন। কোনও ঘটনা ঘটল না। যন্ত্রটা নড়াচড়া করে উঠল না, কোনও শব্দটব্দও কিছু হল না।
টমটম বলল, “এটা দিয়ে কী হবে বাবা?”
গদাইবাবু ঠোঁট উলটে বললেন, “কী জানি বাবা। কিছুই বোধ হয় হবে না। মিস্টিরিয়াস মিস্টার পানচো মিস্টিরিয়াসই থেকে যাবে মনে হচ্ছে। টাকাগুলোই গচ্চা গেল।”
টমটমও হতাশ হয়ে বলল, “খানিকটা মানুষ-মানুষ দেখাচ্ছে বটে, কিন্তু এটা দিয়ে পুতুল-খেলাও যায় না।”
সুতরাং মিস্টার পানচোকে চিলেকোঠার একটি কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা হল। তার কথা আর কারও তেমন মনে রইল না।
পরদিন সকালে বাড়ির গিন্নি বললেন, “রাতে আমাদের বাড়িতে কিন্তু চোর এসেছিল।”
গদাইবাবু বললেন, “চোর এসেছিল! কীরকম?”
“তা কি আমি দেখেছি? মনে হচ্ছে পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে ছাদের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকবার চেষ্টা করছিল। ছাদে হাঁটাহাঁটির শব্দ পেয়েছি।”
“তা হলে ডাকোনি কেন?”
“আজকাল চোরদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র থাকে। তোমাকে ডাকলে তুমি তো ঘুমের চোখে চোর ধরতে ছুটতে, ছোরা বসিয়ে দিলে বা গুলি করলে কী হত? তাই ডাকিনি। তবে চোর বেশিক্ষণ ছিল না। দু-তিন মিনিট বাদেই হাঁটাহাঁটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।”