প্রতিভা রাজি হয়ে বললেন, “সেই ভাল।” বা
বুরাম বললেন, “কিন্তু বনির অসুস্থতা সম্পর্কে বাড়ির লোক কিছুই জানে না। বাবা-মা বনিকে দেখে খুবই মুষড়ে পড়বেন। আমার মনে হয় এঁদের এ ব্যাপারটা চিঠি লিখে আগেভাগেই একটু জানিয়ে দেওয়া ভাল।”
বাবুরাম বাড়িতে চিঠি লিখলেন এবং অফিসে ছুটির দরখাস্ত করে যাওয়ার জন্য অগ্রিম তোড়জোড় শুরু করলেন। বাবুরাম খুবই দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণ বললেই ছুটি পাওয়া শক্ত। অনেক আঁটঘাট বেঁধে তবে ছুটি নিতে হয়।
দেশে যাওয়ার কথায় প্রতিভা খুব খুশি। আমেরিকায় তাঁরা খুবই সুখে আছেন বটে কিন্তু দেশ হল অন্য জিনিস। দরিদ্র হোক, শত অসুবিধে থাকুক তবু ওই মাটির টান কখনও কমে না।
প্রতিভা এক দুপুরবেলা বনিকে আদর করতে করতে বললেন, “জানিস বনি, আমরা তোকে নিয়ে দেশে যাব। তুই দাদু-ঠাম্মাকে দেখবি, দাদামশাই-দিদাকে দেখতে পাবি। কাকা পিসি মাসি মামারা কত আদর করবে তোকে…”
বনির কালো চোখ হঠাৎ নীলকান্তমণির দ্যুতিতে ভরে উঠল। এমন আশ্চর্য নীল প্রতিভা কখনও দেখেননি। তিনি বনিকে বুকে চেপে ধরে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “বনি! বনি! তোর কী হল হঠাৎ?”
এই সময়ে টেলিফোন বেজে উঠল। প্রতিভা গিয়ে টেলিফোন ধরতেই একটা গম্ভীর গলা মার্কিন ইংরেজিতে বলে উঠল, “সুপ্রভাত। আমি কি বনির মা’র সঙ্গে কথা বলছি?”
“হ্যাঁ। আমিই বনির মা। কী চাই?”
“আমরা শুনেছি আপনারা বনিকে নিয়ে ভারতবর্ষে চলে যেতে চাইছেন?”
“হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে?”
“আমি যে-ই হই, যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। বনিকে এ-দেশ থেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে আপনারা ঘোর বিপদে পড়বেন।”
“তার মানে?”
“বনি এ-দেশেই থাকবে। যদি ওকে নিয়ে পালাতে চান তা হলে আপনাদের বাধা দেওয়া হবে এবং বনিকে আপনাদের কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে।”
ফোন কেটে গেল। প্রতিভা স্তম্ভিত হয়ে ফোনটার দিকে চেয়ে। রইলেন।
বাবুরাম বিকেলবেলায় এসে স্ত্রীর কাছ থেকে সব শুনে গম্ভীর ও বিষণ্ণ হয়ে গেলেন। বললেন, “পুলিশের সাহায্য নেওয়া ছাড়া আর তো পথ দেখছি না।”
প্রতিভা মাথা নেড়ে বললেন, “কক্ষনো নয়। পুলিশ এ ব্যাপারে নাক গলালে আমার বনির যদি বিপদ হয়?”
“তা হলে কী করব? ডাক্তার ক্রিল আমাকে সেদিন গোপনে বলেছেন একটা দুষ্টচক্র বনির সম্পর্কে তাঁকেও হুমকি দিয়েছে। এরা নাকি বিপজ্জনক লোক।”
প্রতিভা বললেন, “বনির ভালর জন্য আমাদের সবকিছুই মেনে নিতে হবে।”
বাবুরাম অনেকক্ষণ ভেবে বললেন, “দ্যাখো, আমার মাঝে-মাঝে সন্দেহ হয়, বনির জন্মের পিছনে একটা রহস্যময় কারণ আছে। আমি নিজে সায়েন্টিস্ট বলেই বলছি, কারণটা হয়তো বৈজ্ঞানিক। সেই ডেলাওয়্যার ওয়াটার গ্যাপে বেড়াতে যাওয়ার পথে আমাদের যে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল তার কথা মনে আছে?”
“বাবাঃ, মনে থাকবে না! খুব আছে।”
“আমার মনে হয় ওই অ্যাকসিডেন্টটাও স্বাভাবিক ছিল না। অ্যাকসিডেন্ট স্পট থেকে কে বা কারা আমাদের দুজনকে অনেক দূরে একটা পোড়ো বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। তখন বনি সদ্য মাতৃগর্ভে এসেছে। সেই সময়ে কিছু উন্নত মস্তিষ্কসম্পন্ন লোক এমন কিছু ওষুধ তোমার শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল বা কোনও সূক্ষ্ম উপায়ে গর্ভস্থ ভূণের এমন কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছিল যার ফলে বনির আজ এই অবস্থা।”
“তা হলে আমরা কী করব এখন?”
“আমার সন্দেহ হচ্ছে, বনিকে কোনও একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।”
“সে কী!” বলে আর্তনাদ করে উঠলেন প্রতিভা।
“ঘাবড়ে যেও না। আমরা এখনও প্রায় কিছুই জানি না। শুধু সন্দেহই হচ্ছে। তবু আমার ইচ্ছে এব্যাপারটা নিয়ে একটু অনুসন্ধান করি। সামনের উইক এন্ডে চলো আমরা আবার সেই জায়গাটায় যাই।”
“আবার যদি বিপদ হয়?”
“ভয় পেও না। আমাদের এখন যে বিপদ চলছে তার চেয়ে বেশি বিপদ আর কী হতে পারে? বনি সম্পর্কে আমরা এখনও প্রায় কিছুই জানি না। না জানলে ওর সমস্যার সমাধান করব কীভাবে?”
“বনিকে নিয়েই তো যাব?”
“হ্যাঁ। অবশ্যই।”
প্রতিভা চেয়ে দেখলেন, বনির চোখ থেকে এক আশ্চর্য গোলাপি আভা ঠিকরে বেরোচ্ছে।
“বনি!” বলে ফের চেঁচালেন প্রতিভা।
বাবুরাম গিয়ে ছেলের অসাড় দেহটি কোলে তুলে নিয়ে তার কানেকানে বললেন, “বনি, আমি জানি তোমার শরীর অসাড় হলেও তোমার মগজ নয়। তুমি সবই বুঝতে পারছ। হয়তো আমাদের চেয়েও তোমার মগজের শক্তি বেশি। তুমি কী বলল বাবা, আমরা কি ওই জায়গাটায় যাব? যাওয়া কি উচিত?”
চোখের ভুলও হতে পারে, তবু বাবুরামের মনে হল, বনির ঠোঁটে যেন একটা খুব হালকা হাসির ছোঁয়া চকিতে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।
বনির বয়স মাত্র এক বছর। এই ছোট বাচ্চার বোধ শক্তি প্রবল নয়। বনির ক্ষেত্রে তো আরও নয়। তবু কি বনি বাবুরামের কথা বুঝতে পারল এবং সায় দিল?
বাবুরাম নিশ্চিন্ত হয়ে প্রতিভাকে বললেন, “আমরা যাব।”
প্রতিভা মাথা নেড়ে বললেন, “ঠিক আছে।”
২. গদাইবাবুর একদিন হঠাৎ মনে হল
গদাইবাবুর একদিন হঠাৎ মনে হল, চারদিকে বিজ্ঞানের এমন বাড়বাড়ন্ত হয়েছে যে, এ-যুগে বিজ্ঞান না-জানাটা খুবই খারাপ। অফিস থেকে ফিরে তিনি ছেলে টমটমকে ডেকে বললেন, “ওরে টমটম, এই বিজ্ঞানের যুগে বিজ্ঞান না জানলে তো কিছুই হবে না।”
টমটম মাথা চুলকে মিনমিন করে বলল, “কিন্তু বিজ্ঞান যে আমার মাথায় সেঁধোয় না।”