প্রতিভা করুণ মুখ করে বললেন, “আমাদের দেশ ভারতবর্ষে এত উন্নত ধরনের চিকিৎসা নেই। জল-হাওয়াও ভাল নয়। তা ছাড়া আমরা আমেরিকাকেই আমাদের দেশ করে নিয়েছি।”
ক্রিল মাথা নেড়ে বললেন, “বনির চিকিৎসা পৃথিবীর কোথাও হবে। আমার মনে হয় আমেরিকায় ও নিরাপদ নয়। এখন তোমরা যা ভাল বোঝো করবে।“
তিন-চারদিন পর একদিন সকালবেলায় বাবুরাম অফিসে গেছেন। একটু শীত পড়তে শুরু করেছে। ক’দিনের মধ্যেই কনকনে হাওয়া বইবে, তারপর শুরু হবে তুষারপাত। প্রতিভা কিছু কাঁচাকাচি করে কাপড়গুলো বাইরের রোদে মেলে দিচ্ছিলেন, হঠাৎ নজরে পড়ল, একটা পপলার গাছের তলায় জনাপাঁচেক ভবঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। কারও হাতে ব্যাঞ্জো, কারও বেহালা, কারও বগলে বাঁশি। তারা খুব কৌতূহল নিয়ে এবাড়ির দিকে চেয়ে আছে।
ভবঘুরে দেখে প্রতিভা খুব ভয় পেলেন। তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর জানালার পর্দা সরিয়ে লক্ষ করতে লাগলেন, ওরা কী করে। দেখতে পেলেন, পাঁচ জনের মধ্যে দুজন। মেয়েও আছে। সকলেরই উলোঝুলো পোশাক এবং নোংরা।
প্রতিভা ভেবে দেখলেন, এরা যদি সবাই মিলে দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকে তা হলে তিনি আটকাতে পারবেন না। সুতরাং তিনি পুলিশে ফোন করতে গেলেন। কিন্তু টেলিফোন ডেড। এরাই বোধ হয় তার কেটে দিয়েছে। প্রতিভা শোওয়ার ঘরে গিয়ে কম্পিতবক্ষে বাবুরামের ড্রয়ার খুলে ভারী রিভলভারটা তুলে নিলেন। কোনও বেয়াদবি দেখলে আজ তিনি কিছুতেই ওদের ছাড়বেন না। তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে নীচে নেমে এসে দরজা খুলে বেরোতে গিয়ে ভীষণ অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন।
পাঁচ জন বাউন্ডুলে, উলোঙ্কুলো পোশাক-পরা পুরুষ ও মেয়ে তাদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গান গাইছে একযোগে। গানের কথা বোঝা যাচ্ছে না, তবে মনে হয় এরা কারও জয়ধ্বনি দিচ্ছে। প্রতিভাকে দেখে গান গাইতে গাইতেও তারা অভিবাদন জানাতে লাগল বার বার।
কিছুক্ষণ বাদে গান থামিয়ে একজন এগিয়ে এসে বলল, “সুপ্রভাত। আমরা শুনেছি, তোমার একটি শিশুপুত্র আছে এবং সে অলৌকিক ক্ষমতা ধরে। আমরা তাকে একবার দেখতে এসেছি। ভয় নেই, আমরা দূর থেকে তাকে একবার দেখব এবং কিছু উপহার দিয়ে চলে যাব।”
“তোমরা কার কাছে একথা শুনেছ?”
“সে আমাদের বন্ধু এক বাউন্ডুলে। তার নাম এডি। সে চুরি করতে তোমার বাড়িতে ঢুকেছিল। তোমার ছেলেকে দেখে সে ভয়ে পেয়ে পালিয়ে যায়। আজও তার ভয় কাটেনি। সে বলছে, স্বয়ং ঈশ্বরপুত্র তাকে ভর্ৎসনা করেছেন।”
প্রতিভার মনটা প্রসন্ন হয়ে গেল। তিনি ওপরে গিয়ে বনিকে কোলে নিয়ে নেমে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। বাউন্ডুলেরা মুগ্ধ চোখে বনিকে দেখল, তারপর সকলেই সাষ্টাঙ্গে উপুড় হয়ে পড়ে ভূমি-চুম্বন করে উঠে কেউ সিকি ডলার, কেউ একটা ফল, কেউ তার বাঁশিটা উপহার হিসেবে দরজার সামনে রাখল। তারপর নিঃশব্দে চলে গেল।
এরকম দৃশ্য প্রতিভা কখনও দেখেননি। যেমন অবাক হলেন, তেমনই খুশিও হলেন। ভবঘুরে বাউন্ডুলেরা সবাই তা হলে খারাপ নয়।
দুদিন পরেই হঠাৎ হইহই করে বাড়িতে এসে চড়াও হল টেলিভিশন টিম। তাদের সঙ্গে ক্যামেরা, রিফ্লেক্টর, যন্ত্রলাগানো গাড়ি। হাসপাতাল সূত্রে তারা শুনেছে বনি এক অদ্ভুত শিশু। তারা বনির খবর সারা দেশে প্রচার করতে চায়।
বাবুরাম আর প্রতিভার সাক্ষাৎকারও তারা নিল। পরদিন টেলিভিশনে বনির ছবি আর বাবুরাম এবং প্রতিভার সাক্ষাৎকার ফলাও করে প্রচার করা হল। ফলে পরদিন থেকেই কৌতূহলী লোকজন আসতে লাগল বনিকে দেখতে। তারা নানা রকম উপহারও দিয়ে যেতে লাগল। এল অজস্র টেলিফোন। আসতে লাগল চিঠি, টেলিগ্রাম, ডলার। বাবুরাম আর প্রতিভা অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে লাগলেন।
বাবুরাম ডাক্তার ক্রিলকে টেলিফোন করে বললেন, “বনির কথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এভাবে মিডিয়াকে জানিয়ে দিয়ে ঠিক কাজ করেনি ডাক্তার ক্রিল। আমাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।”
ডাক্তার ক্রিল খুব মোলায়েম গলায় বললেন, “আমি এরকমই চেয়েছিলাম। যাতে অতিষ্ঠ হয়ে তোমরা আমেরিকা ছেড়ে পালাও। তোমাদের কি যাওয়ার জায়গা নেই?”
বাবুরাম বিষঃ গলায় বললেন, “আছে। কিন্তু…”
“কোনও কিন্তু নেই। তোমাদের চলে যাওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। আমি তোমাদের একটা কথা এতদিন বলিনি, আজ বলছি। বনির ওপর একটা দুষ্টচক্রেরও নজর আছে। তারা কী করতে চায় আমি জানি না। কিন্তু বনির ওপর অস্ত্রোপচার তারাই আমাকে করতে দেয়নি। সাবধান থেকো, আমার বিশ্বাস, তারা লোক ভাল নয়।”
বাবুরাম একথায় খুব ভয় পেলেন। কিন্তু প্রতিভাকে কিছুই বললেন না।
বাবুরাম ভেবে দেখলেন, বনিকে নিয়ে তিনি দেশে ফিরে যেতে পারেন। সেখানে তাঁর বুড়ো বাবা আছেন, মা আছেন, ভাই-বোনেরাও আছেন। বনি সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানেন না। বনি যে অস্বাভাবিক, বনি যে অসাড় এবং পঙ্গু এই সংবাদ তাঁদের জানাননি বাবুরাম। ভেবেছিলেন চিকিৎসা করে বনিকে সুস্থ করে দেশে গিয়ে মা বাবাকে দেখিয়ে আনবেন। বাবাও নাতিকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে বার বার চিঠি দিচ্ছেন। চিঠি দিচ্ছেন মাও। নাতির কী নাম রাখা হবে তাই নিয়ে দাদু আর ঠাকুমাতে নাকি রোজই। তকাতর্কি হচ্ছে।
বাবুরাম প্রতিভাকে বললেন, “এই টেনশন আর লোকজনের ভীড় আর ভাল লাগছে না। চলো, দেশ থেকেই ক’দিনের জন্য ঘুরে আসি।”