প্রতিভা কী বলবেন ভেবে পেলেন না। লোকটার হাবভাব তাঁর ভাল লাগছে না। “দাঁড়াও।” বলে প্রতিভা দরজাটা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন।
লোকটা তার পায়ের বুট দরজার ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা আটকাল।
চেঁচিয়ে কোনও লাভ নেই। কেউ শুনতে পাবে না। সারা শহর এখন খাঁখাঁ জনশূন্য। প্রতিভা প্রাণপণে দরজাটা চেপে ধরার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। লোকটাও তেমন ঠেলাধাক্কা করল না, শুধু ভারী বুট দিয়ে দরজাটা আটকে দাঁড়িয়ে রইল।
প্রতিভা ছুরিটা শক্ত করে ধরে দরজার ফাঁক দিয়ে লোকটার দিকে চেয়ে বললেন, “কী চাও?”
লোকটা একটু হেসে বলল, “এই তো কাজের কথা ম্যাডাম। গায়ের জোর দেখিয়ে লাভ নেই। আমি কিছু টাকা চাই। দশ-বিশ ডলার হলেই চলবে। আর কিছু খাবার। বাসী হলেও আপত্তি নেই।”
প্রতিভা আর কী করেন, মনে আতঙ্ক নিয়েই লোকটাকে তাড়ানোর জন্য তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে এসে একটা আস্ত পাউরুটি, এক প্যাকেট মাখন, একটা পিচ আর একটা আপেল একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরলেন। পাঁচটা ডলার হাতে নিয়ে সদর দরজার দিকে আসতেই দেখলেন, লোকটা দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকে পড়েছে এবং চারদিকে চেয়ে দেখছে। হাবভাব ভাল নয়।
প্রতিভা পিছিয়ে গিয়ে খাওয়ার টেবিল থেকে আবার ছুরিটা তুলে নিলেন তারপর এগিয়ে গিয়ে বললেন, “তোমার যথেষ্ট দুঃসাহস। কার হুকুমে তুমি ঘরে ঢুকেছ?
আমার কারও হুকুমের দরকার হয় না। ছুরিটা রেখে দাও, ওটা যদি ব্যবহার করার ইচ্ছে থাকে তা হলে সেটা ছেলেমানুষী হবে।
প্রতিভা কী করবেন ভেবে পেলেন না। খুব ভয় পেয়েছেন, কিন্তু কিছু করারও নেই। শুধু বললেন, “তুমি কী চাও? এই খাবার নাও, পাঁচটা ডলার দিচ্ছি, নিয়ে যাও। কিন্তু দয়া করে বিদেয় হও।”
লোকটা প্রতিভার কথায় কর্ণপাত করল বলে মনে হল না, পাত্তাও দিল না। শিস দিতে দিতে ঘুরে ঘুরে ঘরের জিনিসপত্র দেখতে লাগল। বেশ বেপরোয়া ভাব। প্রতিভা চেষ্টা করলেও লোকটাকে ছুরি মারতে পারবেন না এটা তিনি ভাল জানেন। সুতরাং তিনি লোকটার দিকে আতঙ্কিত চোখে চেয়ে রইলেন শুধু।
লোকটা চারদিক দেখতে দেখতে এ-ঘর থেকে ও-ঘর যাচ্ছিল। প্রতিভা একটু ব্যবধান রেখে তাকে অনুসরণ করতে লাগলেন। লোকটা ধীরেধীরে দোতলায় উঠল।
প্রতিভা চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওখানে আমাদের শোওয়ার ঘর। কেন ওখানে যাচ্ছ?”
“শোওয়ার ঘরেই মানুষ মূল্যবান জিনিসগুলি রাখে।”
“প্লিজ! ও-ঘরে আমার ছেলে ঘুমোচ্ছে। সে অসুস্থ। শব্দ করলে জেগে যাবে।”
লোকটা প্রতিভাকে গ্রাহ্যই করল না। দোতলায় উঠে প্রতিভার শোওয়ার ঘরে ঢুকল। বনির নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রতিভা তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে ছেলেকে আগলে বসলেন।
লোকটা বনির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “তোমার ছেলে তত জেগেই আছে দেখছি।”
প্রতিভা দেখলেন সত্যিই বনির চোখ খোলা। সে তাকিয়ে আছে।
লোকটা হঠাৎ বলল, “তোমার ছেলের চোখের রং কি লাল? টকটকে লাল?”
“না। আমার ছেলের চোখের রং কালো।”
লোকটা হঠাৎ যেন উত্তেজিত হয়ে বলল, “ভাল করে দ্যাখো, তোমার ছেলের চোখের রং লাল। ঘোর লাল।”
প্রতিভা বনির দিকে চেয়ে এত অবাক হয়ে গেলেন যে, বলার নয়। বনির চোখের কালো মণিদুটো দুটি চুনি পাথরের মতো লাল আর ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। এরকম অস্বাভাবিক চোখ প্রতিভা কখনও দেখেননি।
“ও মা! বনির কী হল!” বলে তিনি তাড়াতাড়ি ছেলেকে জাপটে ধরলেন।
লোকটা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “সবুজ! ওর চোখের রং সবুজ হয়ে যাচ্ছে! এ তো ভূতড়ে ব্যাপার।
প্রতিভা বনির চোখের দিকে চেয়ে স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন, চুনি নয়। দুটি চোখ পান্নার মতো সবুজ। চোখ থেকে যেন দ্যুতি ঠিকরে আসছে।
ভবঘুরেটার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। শুকনো ঠোঁট চাটতে চাটতে লোকটা পিছু হটে দরজার কাছে পৌঁছল। তারপর দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে দড়াম করে সদর দরজা বন্ধ করে পালিয়ে গেল। প্রতিভা জানালার দিকে দেখলেন, লোকটা রাস্তা ধরে ছুটছে।
প্রতিভা দেখলেন, বনির চোখের রং আবার কালো হয়ে গেছে।
প্রতিভা ঘাবড়ে গেছেন বটে, কিন্তু জোর করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন, বাবুরামের ফেরার জন্য। বনির জন্য তাঁর এত দুশ্চিন্তা হল যে, সারাদিন তিনি বনিকে আর কোল-ছাড়া করলেন না। বনির কি চোখের দোষ আছে? বনির ওপর কি কোনও অপদেবতার ভর হয়? নইলে চোখের রং অমন অস্বাভাবিকভাবে পালটে যাবে কেন?
বিকেলে বাবুরাম ফিরে সব শুনলেন। টেলিফোন করে তক্ষুনি ডাক্তার ক্রিলের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা হল। পরদিন সকাল সাতটায় ক্রিল বনিকে দেখবেন। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
পরদিন হাসপাতালে শুধু ডাক্তার ক্রিল নয়, একজন চোখের ডাক্তারও বনিকে ভাল করে দেখলেন। তাঁরা মত দিলেন, বনির চোখে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। বনির চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক।
ক্রিল প্রতিভাকে ঘটনাটি সম্পর্কে খুঁটিনাটি প্রশ্ন করে সব জেনে নিলেন। তারপর চিন্তিতভাবে বললেন, “তুমি বলছ যে, বনির চোখের তারার রং পাল্টে যাচ্ছিল? আশ্চর্যের বিষয় এই অবিশ্বাস্য ঘটনাকে আমি কেন যেন ঠিক অবিশ্বাস করতে পারছি না। বনির ক্ষেত্রে সবই সম্ভব। আমি তোমাদের আবার বলছি, বনিকে আমেরিকায় রাখাটা ঠিক হবে না। তোমরা যদি পারো ওকে নিয়ে কোনও দূর দেশে চলে যাও।”