স্বামী-স্ত্রী বিদায় নিলে ডাক্তার ক্রিল আরও কিছুক্ষণ চিন্তাচ্ছন্ন রইলেন। তারপর রুগি দেখতে উঠতে হল।
বাবুরাম ও প্রতিভা সারাদিনই বনিকে নিয়েই কথা বলেন এবং বনিকে নিয়েই চিন্তা করেন। বিশেষ করে বনির ভবিষ্যৎ। এই নিষ্ঠর উদাসীন পৃথিবীতে বনির মত অসহায় শিশুর কী দশা হবে? কে। দেখবে ওকে? ও কি কোনওদিন হাঁটতে, চলতে বা কথা বলতে পারবে?
প্রতিভা ও বাবুরাম রোজই হাসপাতালে যান। বনিকে দেখে আসেন। তিনদিন বাদে ডাক্তার ক্রিল বললেন, “বনির অবজারভেশন শেষ হয়েছে। এবার ওকে আপনারা নিয়ে যেতে পারেন।”
বাবুরাম অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “অবজারভেশনে কী পেলেন?”
ক্রিল খানিকক্ষণ বাবুরামের মুখের দিকে চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে বললেন, “আমার মনে হয় বনি নির্বোধ নয়।”
“তার মানে কী ডাক্তার?”
“আমাদের যন্ত্রপাতি এবং কম্পিউটার বলছে, বনির মস্তিষ্ক ক্রিয়াশীল। তার হাত-পা-জিভ অসাড় হলেও তার মাথা নয়।”
“ও কি ভাল হবে?”
“তা বলা কঠিন। ভাল-মন্দ সম্পর্কে আমাদের ধারণা সাবেক কালের। হয়তো এ-সব ধারণা ভবিষ্যতে পালটাতে হবে।”
“এ-কথার অর্থ কী?”
“এর চেয়ে বেশি বলা আপাতত সম্ভব নয়।”
বাবুরাম জিজ্ঞেস করলেন, “বাড়িতে ওর চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা কি করে দেবেন?”
ক্রিল মাথা নেড়ে বললেন, “কোনও চিকিৎসা নয়। শুধু লক্ষ। রাখবেন। আর-একটা কথা। যদি পারেন বনিকে নিয়ে খুব দূরে কোথাও চলে যাবেন। কোনও নিরাপদ জায়গায়।”
“এ-কথার মানে কী ডাক্তার ক্রিল?”
“আমার মনে হয় আমেরিকা বনির পক্ষে খুব নিরাপদ জায়গা নয়।”
অনেক ঝুলোঝুলি করেও ডাক্তার ক্রিলের কাছ থেকে এর বেশি আর কিছু বোঝা গেল না। বাবুরাম ও প্রতিভা বনিকে নিয়ে তাঁদের নিউ জার্সির বাড়িতে ফিরে এলেন।
নিউ জার্সি খুব ছোট শহর নয়। কিন্তু আমেরিকার এসব শহর খুব নির্জন। রাস্তায় লোকজন প্রায় দেখাই যায় না। মাঠ, পার্ক, অরণ্য, খেলার মাঠ সবই আছে, কিন্তু বড় নিরিবিলি। এ-দেশে কারও বাড়িতেই বেশি লোজন থাকে না, যৌথ পরিবার নেই। এক-একটা বাড়িতে কেবলমাত্র স্বামী-স্ত্রী আর একটা-দুটো বাচ্চা থাকে। যে যার আপনমনে থাকে, এবাড়ি ওবাড়ি যাতায়াত বা গল্পগুজব করার সময় কারও নেই। এ হল কাজের দেশ। ফলে অধিকাংশ বাড়িই সকালবেলা থেকেই ফাঁকা হয়ে যায়।
বাবুরামের বাড়িটাও এইরকম নির্জন এক পাড়ায়। চারদিকে লম্বা-লম্বা গাছে ছাওয়া ভারী সুন্দর বাড়ি। এ-দেশে বাড়ির সামনে এবং পিছনে লন বা ঘাসজমি রাখতেই হয়। সব বাড়িরই মাটির তলায় একটা করে প্রশস্ত ঘর থাকে, তাকে বলে বেসমেন্ট। একতলায় সাধারণত বৈঠকখানা, লিভিংরুম, রান্না আর খাওয়ার ঘর থাকে। ওপরতলায় শোওয়ার ঘর। বাবুরাম সকাল সাতটার মধ্যেই বেরিয়ে যান। সারাদিন বাড়িতে প্রতিভা ছেলে বনিকে আগলে নিয়ে থাকেন। বনিকে নিয়ে কোনও ঝামেলা নেই। জেগে থাকলে সে চেঁচায় না বা কাঁদে না। শুধু চেয়ে থাকে। যখন ঘুমোয় তখন চোখ বুজে থাকে। চোখের পাতা ছাড়া বনির শরীরে আর কোনও কিছুই নড়ে না। তবে বনি খায়। দুধ, ফলের রস খেতে সে খুব ভালবাসে, এটা প্রতিভা বুঝতে পারেন। বনির স্বাস্থ্যও মোটামুটি ভালই।
প্রতিদিন সকালে ঘরের যত আবর্জনা, তরকারির খোসা বা এটোকাঁটা একটা প্লাস্টিকের থলিতে করে নিয়ে বাড়ির সামনে রেখে দিতে হয়। গারবেজের গাড়ি এসে সেটা নিয়ে যায়। একদিন সকালে প্রতিভা গারবেজ ব্যাগ রাখতে গিয়ে হঠাৎ দেখলেন, রাস্তার ও-পাশে একটা পপলার গাছের নীচে একজন ভবঘুরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁকেই লক্ষ করছে। লোকটার মাথায় একটা তোবড়ানো টুপি, চুল-দাড়ি-গোঁফে মুখটা আচ্ছন্ন, গায়ে ময়লা কোট, পরনে প্লিমারা ট্রাউজার্স, পায়ে নোংরা বুটজুতো, গলায় বড়-বড় লাল পুঁতির একটা মালা আর কাঁধে একটা বেহালার বাক্স। বিচিত্র চেহারা এবং পোশাকের এইসব ভবঘুরেকে অবশ্য আমেরিকার সর্বত্রই দেখা যায়। এরা আবর্জনা ঘেঁটে খাবার বা পয়সা খোঁজে, ভিক্ষে করে, নেশাভাঙের পয়সা জোটাতে চুরি তো করেই, খুনখারাপিতেও পিছপা হয় না।
প্রতিভা অবশ্য ভয় পেলেন না। আমেরিকায় তিনি অনেকদিন আছেন। ভবঘুরেও বিস্তর দেখেছেন। কিন্তু লোকটা এমন স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে চেয়ে আছে যে, ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। তিনি তাড়াতাড়ি ঘরে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
একটু বাদেই হঠাৎ ডোরবেল বেজে উঠল। এই অসময়ে কারও আসবার কথা নয়। আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করে এখানে কেউ কারও বাড়ি যায় না। তবে সেলসম্যান বা ডাকপিয়ন হতে পারে। কিন্তু তা হলে সামনে গাড়ি পার্ক করা থাকবে। এখানকার সেলসম্যান বা ডাকপিয়ন গাড়ি ছাড়া আসবে না। প্রতিভা দোতলার ঘর থেকে কাঁচের শার্শি দিয়ে উঁকি মেরে কোনও গাড়ি দেখতে পেলেন না। তবে লক্ষ করলেন, পপলার গাছের নীচে ভবঘুরেটা নেই।
প্রতিভার বুকটা একটু কেঁপে উঠল। ভবঘুরেটাই কি ডোরবেল বাজাল? প্রতিভা অবশ্য এসব পরিস্থিতিতে আগেও পড়েছেন। সুতরাং ঘাবড়ালেন না। তাড়াতাড়ি একতলায় নেমে রান্নাঘরের টেবিল থেকে বড় তরকারি কাটার ছুরিটা হাতে নিয়ে গিয়ে দরজাটা খুললেন। দরজায় চেন লাগানো, চট করে কেউ ঢুকতে পারবে না।
সেই ভবঘুরেটাই একগাল হাসি নিয়ে বলল, “সুপ্রভাত। আমি বড় ক্ষুধার্ত। কিছু দিতে পারেন?”