ক্রিল সামান্য উম্মার সঙ্গে বললেন, “এটা কোন ধরনের রসিকতা? ডাক্তার তো ভগবান নয়ই।”
“সেজন্যই তোমাকে সাবধান করা হচ্ছে। তা ছাড়া বনির কী। হয়েছে তাও তুমি ভাল করে জানো না। তোমার অপারেশন হবে। অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো।”
ক্রিল রেগে গিয়ে বললেন, “তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন বনির কী হয়েছে তা তোমরা আমার চেয়ে বেশি জানো!”
“কথাটা মিথ্যে নয় ডাক্তার ক্রিল। আমরা সত্যিই জানি। আর জানি বলেই বলছি, বাচ্চাটা যেমন আছে তেমনই থাকতে দাও।”
“এভাবে বেঁচে থেকে ওর লাভ কী?”
“সেটা তুমি বুঝবে না।”
“তোমরা কারা?”
“আমরা বনির বা তোমার শত্রু নই। শোনো ডাক্তার ক্রিল, আমাদের সংগঠন অতিশয় শক্তিশালী। আমরা যা বলছি তা না শুনলে তোমার বিপদ হবে। এখন যে তুমি অসুস্থতা বোধ করছ তার কারণ জানো? তুমি অস্থির বোধ করছ, তোমার ঘাম হচ্ছে, বুকে একটা চাপ অনুভব করছ-তাই না?”
ডাক্তার ক্রিল হাঁফধরা গলায় বললেন, “হ্যাঁ। তোমরা কী করেছ আমাকে? খাবারে বিষ মিশিয়েছ?”
“বিকেলে হাসপাতালে তুমি যে কফি খেয়েছিলে তাতে বিলম্বিত-ক্রিয়ার বিষ মেশানো ছিল। কাল সকালে তোমার অসুস্থতা আরও বাড়বে। বিষটা পৌঁছবে তোমার হৃৎপিণ্ডে। এই বিষের প্রতিষেধক তোমার জানা নেই।”
“আমি কি মারা যাব?”
“যাবে, যদি বনির ওপর অস্ত্রোপচার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত না নাও।”
“যদি অস্ত্রোপচার না করি তা হলে?”
“যদি কথা দাও অস্ত্রোপচার করবে না তা হলে কাল সকালে হাসপাতালে এসে প্রথম যে কফিটা খাবে তাতে আমরা বিষের অ্যালিডোট মিশিয়ে দেব। তবে তোমার শরীর সকালে আরও খারাপ হবে। হাসপাতালে নিজে গাড়ি চালিয়ে এসো না। একটা ক্যাব বা ভাড়াটে গাড়ি নিয়ে এসো। ভয় নেই, আমাদের কথা শুনে চললে তোমার কোনও ক্ষতি করা হবে না।”
ফোন কেটে গেল। ডাক্তার ক্রিল অবিশ্বাসের চোখে রিসিভারের দিকে চেয়ে রইলেন। বিশ্বাস হচ্ছে না বটে, কিন্তু তাঁর শরীর যে খারাপ তা তো মিথ্যে নয়।
রাত পোহানোর জন্য ক্রিল অপেক্ষা করলেন না। একটা এজেন্সিতে টেলিফোন করলেন চালকসহ গাড়ির জন্য। তারপর পোশাক পরে নিলেন চটপট। মাঝে-মাঝেই তিনি শ্বাসকষ্ট অনুভব করছেন, ঘাম হচ্ছে, বুকের চাপ বেড়ে যাচ্ছে।
ক্রিল যখন হাসপাতালে পৌঁছলেন তখনও ভোর হতে অন্তত দু’ঘণ্টা বাকি। রাতের কর্মচারীরা অবশ্য তাঁকে দেখে অবাক হল না, ভাবল, কোনও গুরুতর রুগিকে দেখতে এসেছেন।
নিজের ঘরে গিয়েই তিনি কফি চেয়ে পাঠালেন ফোনে। তারপর নিঝঝুম হয়ে বসে ঘটনাটা বিচার করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
কফি এসে গেল। যে কফি আনল সে পুরনো লোক। গত দু’ বছর ধরে এ কাজ করছে।
ওরা বলেছিল প্রথম কাপ কফিতেই অ্যালিডোট মেশানো থাকবে। আছে কি? ভ্রু কুঁচকে ভাবতে-ভাবতে তিনি কফিতে চুমুক দিলেন।
কফি শেষ করার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ডাক্তার ক্রিল বুঝতে পারলেন যে, তাঁর শরীরে একটা পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি অনেক ঝরঝরে এবং সুস্থ বোধ করছেন।
তিনি ধীরে-ধীরে বনির ঘরে এসে তার ছোট্ট বিছানাটার পাশে দাঁড়িয়ে শিশুটির দিকে নিস্পলক চেয়ে রইলেন। এই শিশুটিকে ঘিরে কোন রহস্য দানা বেঁধে উঠছে? কেন কিছু লোক চাইছে বনির চিকিৎসা বন্ধ করতে?
বনি ঘুমোচ্ছে। চোখ বোজা। জেগে থাকলেও বনি কোনও শব্দ করে না। কাঁদে না, হাসেও না। কেবল চুপ করে চেয়ে থাকে। এই কাঠের পুতুলের মতো বাচ্চাটি সম্পর্কে কার এত আগ্রহ?
হঠাৎ ডাক্তার ক্রিল লক্ষ করলেন, বনি চোখ চেয়ে সোজা তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। সোজা তার চোখের দিকে। ডাক্তার ক্রিল একটু ঝুঁকে বনির দিকে চেয়ে রইলেন। খুব তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করতে লাগলেন শিশুটিকে। তাঁর কেমন যেন মনে হল, বনি সম্পর্কে তাঁর পূর্ব সিদ্ধান্তে কোনও ভুল আছে। আজ তিনি বনির চোখ দেখে। বুঝতে পারলেন, এই শিশুটির আর সব অসাড় হলেও, মস্তিষ্ক অসাড় নয়। ওর চোখের দৃষ্টিতে একটি ক্রিয়াশীল মস্তিষ্কের প্রতিফলন রয়েছে। বনি আর যাই হোক, বোধহীন শিশু নয়।
বনির বাবা-মা সকালবেলায় যখন হাসপাতালে এল তখন ক্রিল তাঁর চেয়ারে গভীর চিন্তায় মগ্ন। তাঁর কপালে দুশ্চিন্তার কুঞ্চন।
বাবুরাম আর প্রতিভাকে আনমনেই অভ্যর্থনা জানালেন ক্রিল। তারপর ম্লান মুখে বললেন, “দুঃখিত, কোনও বিশেষ কারণে বনির অপারেশন করা সম্ভব নয়।”
বাবুরাম অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে বললেন, “কেন?”
“কারণটা অত্যন্ত জটিল। মেডিক্যাল টার্মস আপনারা ভাল বুঝবেন না। তবে অপারেশনটা বনির পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে। আমার মনে হয়, বনি এখন যেমন আছে তেমনই থাক।”
“কিন্তু….”
ক্রিল একটু চাপা স্বরে বললেন, “কোনও কিন্তু নেই। বনির অপারেশন হচ্ছে না। আমি ওকে আরও কয়েকদিন অবজার্ভেশনে রেখে ছেড়ে দেব।”
অপারেশন হবে না শুনে প্রতিভা কিন্তু খুশিই। তিনি স্বামীকে বললেন, “শোনো, বনি যদি বেঁচে থাকে তা হলেই আমাদের ঢের।
আমি আর কিছু চাই না।”
বাবুরাম হতাশ গলায় বললেন, “কিন্তু এ তো ঠিক বেঁচে থাকা নয়। ওকে কে দেখবে আমাদের মৃত্যুর পর?”
প্রতিভা বললেন, “আমাদের মরতে এখনও ঢের দেরি। ততদিনে একটা কিছু হয়ে যাবেই।”
বাবুরাম ডাক্তার ক্রিলের দিকে চেয়ে বললেন, “আমরা কবে বনিকে নিতে আসব?”
ডাক্তার ক্রিল মাথা নেড়ে বললেন, “বলতে পারছি না। খুব বেশি হলে তিন-চারদিন।”