সেই চিৎকার অবশ্য পুরু প্লেক্সি গ্লাস ভেদ করে ও-পাশে যাবে না। তবে একটা গম্ভীর গলা মাইক্রোফোনে বলে উঠল, “চেঁচিয়ে লাভ নেই। চিন্তা করবেন না, বনির ব্যথা-বেদনার কোনও বোধ নেই। ওর মাথার খুলি খুব সূক্ষ্ম যন্ত্র দিয়ে চিরে ফেলা হবে। এই দেখুন, লেসার যন্ত্র নিয়ে ডক্টর লিভিংস্টোন নিজেই কাজটা করছেন।”
প্রতিভা তবু পাগলের মতো চেঁচাতে লাগলেন, “বনি! বনি! বনি!”
কণ্ঠস্বর বলে উঠল, “ওই দেখুন, বনির চোখের রং কেমন পালটে সবুজ হয়ে গেল। আবার গাঢ় লাল। এই লক্ষণটাই বিপজ্জনক। তার মানে হল, বনির মগজের মাইক্রোচিপ যথাযথ কাজ করছে না। আমাদের কমপিউটার তরঙ্গ ঠিকমতো ধরতে পারছে না। ওকে যদি আদেশ দেওয়া হয়, তুমি তোমার বাবাকে খুন করো, ও হয়তো তা না করে বাবার গালে একটা চুমু খাবে। সেইজন্যই আমাদের দেখতে হবে, কোথায় আমাদের ত্রুটি থেকে যাচ্ছে, কোথায় ভুল হচ্ছে। বিজ্ঞান চিরকালই এভাবে সত্যে পৌঁছেছে। বনি একটা সামান্য শিশু মাত্র…”
প্রতিভা কোনও কথাই শুনলেন না, পাগলের মতো চেঁচাতে লাগলেন, “বনি! বনি! বনি!”
বাবুরাম প্রতিভাকে কিছুই বললেন না। চুপ করে বসে রইলেন। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত।
ওদিকে বনির চোখের মণি ক্রমশ রক্তাভা ধারণ করল। এত লাল যে, দূর থেকেও প্রতিভা ওর চোখের দুটি আলো ঝলমল করছে। দেখতে পেলেন।
লিভিংস্টোন নামক লোকটি ঝুঁকে পড়লেন বনির ওপর, হাতে একটি যন্ত্র।
হঠাৎ আলো নিবে গেল। চারদিকে এক পাথরের মতো নিরেট অন্ধকার।
প্রতিভা একটানা চিৎকার করে যাচ্ছিলেন, “বনি! বনি! বনি!”
সেই জমাট অন্ধকারে হঠাৎ পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে কার বেশ উত্তেজিত গলা শোনা গেল, “এটা কী হচ্ছে, ইমার্জেন্সি লাইট জ্বলছে না কেন?”
কে যেন জবাব দিল, “টর্চ অবধি জ্বলছে না। তাজ্জব ব্যাপার।” আর-একজন বলে উঠল, “আমার লাইটারও জ্বলল না তো!”
সেই জমাট অন্ধকারে শুধু বনির দু’খানা রক্তচক্ষু দেখা যাচ্ছিল। আর কিছু নয়।
“বনি! আমার বনি! আমার বনি!” প্রতিভা কাঁচের গায়ে নিজের মাথা ঠুকছেন।
বাবুরাম নিঃশব্দে উঠলেন। আন্দাজে বাঁ দিকে দরজা লক্ষ করে এগিয়ে গেলেন। লিফট। উঠে দাঁড়াতেই লিফটটা নিঃশব্দে খানিকটা নেমে দাঁড়াল।
বাবরাম সোজা হেঁটে গিয়ে একটা দরজায় ধাক্কা খেলেন। হাতড়ে দরজার নব পেয়ে একটানে খুলে ফেললেন দরজা। ঘরটা একটা লাল আলোয় ভরে আছে। আবছা আলো। কিন্তু তাতে অপারেশন থিয়েটারটা চিনতে তাঁর দেরি হল না।
বনির টেবিলের ধারে কয়েকজন সাদা পোশাক-পরা মানুষ একটু অপ্রস্তুত অবস্থায় দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গলায় আলোচনা করছে।
বাবুরাম সামান্য চেষ্টাতেই অপারেশনের যন্ত্রপাতি রাখার ট্রেটা দেখতে পেলেন। একটা সার্জিকাল ছোরা তুলে নিলেন হাতে। বনির চোখের আলো তাঁকে পথ দেখাচ্ছে।
নিঃশব্দে তিনি এগিয়ে গেলেন। ডক্টর লিভিংস্টোনকে চিনতে কষ্ট নেই। তাঁর হাতে এখনও লেসার গান। বাবুরাম তাঁর পিছনে গিয়ে সামান্য একটু দ্বিধা করলেন। আবার খুন!
কে যেন তাঁকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে সতর্ক করতে চেষ্টা করল ডক্টর লিভিংস্টোনকে। লিভিংস্টোন ঘুরে তাঁর মুখোমুখি হতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে বাবুরাম ছোরাটা তুললেন।
কিন্তু শেষ অবধি ছোরাটা বসাতে পারতেন কি না তা নিয়ে বাবুরামের সন্দেহ আছে। শত অনিষ্টকারী শত্রু হলেও বাবুরাম কোনও মানুষকে এরকমভাবে মেরে ফেলতে হয়তো পারতেন না। ছোরাটা তুলেছিলেন বাবুরাম, তুলেই রইলেন। মারতে পারলেন না।
লিভিংস্টোন চট করে লেসার গান ফেলে পকেট থেকে চোখের পলকে একটা পিস্তল বের করলেন।
বাবুরাম বোকার মতো চেয়ে দেখলেন পিস্তলের নল সোজা তাঁর বুকের দিকে তাক করা।
ঠিক এই সময়ে একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল খুব কাছেই কোথাও। একটা আলোর ঝলকানি।
লিভিংস্টোন চমকে উঠে চেঁচালেন, “মাদার কমপিউটার! মাদার-কমপিউটার! সর্বনাশ! কে মাদার কমপিউটারের নাগাল পেল?”
বনির চোখের আলো নিবে গেল।
অন্ধকারে কে কারা যেন দৌড়াদৌড়ি করে হুড়মুড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আর রোমাঞ্চিত বিস্ময়ে ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বাবুরাম হঠাৎ
শুনতে পেলেন, একটি শিশুর কান্না। প্রচণ্ড কাঁদছে।
“বনি! বনি!” চেঁচিয়ে উঠলেন বাবুরাম। হাতড়ে-হাতড়ে টেবিলটার কাছে যেতেই তাঁর হাতে ঠেকল বনির হাত আর পা। বনি কাঁদতে কাঁদতে হাত-পা ছুঁড়ছে।
.
পর দিন কাগজে এবং টেলিভিশনে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে একটি খবর প্রচারিত হল। ডক্টর লিভিংস্টোনের ক্লিনিকে বিস্ফোরণজনিত অগ্নিকাণ্ডে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের মধ্যে লিভিংস্টোনও আছেন। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে লিভিংস্টোনের ক্লিনিকে কিছু অবৈধ যন্ত্রপাতি এবং কনস্ট্রাকশন ছিল। সরকার থেকে এ-বিষয়ে আরও তদন্ত চালানো হবে…..
সকালবেলায় বাবুরাম খুব মন দিয়ে কাগজ পড়লেন এবং টিভির খবর শুনলেন।
শোওয়ার ঘরে খাটের ওপর বনি হাত-পা ছুঁড়ে প্রবল বিক্রমে খেলা করছে। মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছেন প্রতিভা। বুকের ভার নেমে গেছে। তাঁর ক্লান্ত মুখে মায়ের গর্বের হাসি।
পনেরো দিন পরে ডক্টর ওয়াং হাসপাতাল থেকে টেলিফোন করলেন, “গাঙ্গুলি, অভিনন্দন।”
“অভিনন্দন আমার প্রাপ্য নয় ডক্টর ওয়াং। প্রাপ্য চি চেং-এর। কিন্তু…”