“ফ্রেড, মাইক, তোমরা এখন কী করতে চাও?” বাবুরাম জিজ্ঞেস করলেন।
“কী করব তা বুঝতে পারছি না। লিভিংস্টোন পুলিশের কাছে নালিশ করেছে। পুলিশ তো আর জানে না যে, লিভিংস্টোন কী কাণ্ড করছে। প্রমাণ করাও সহজ নয়। ফলে পুলিশ তাকে প্রোটেকশন দিচ্ছে। ইচ্ছে থাকলেও ওই ক্লিনিকে আর হামলা করা সম্ভব নয়। লিভিংস্টোন ধূর্ত লোক।”
বাবুরাম বাড়ি ফিরে এলেন। তিনি কোনও পথই খুঁজে পাচ্ছেন
দুপুরবেলা আবার কমপিউটারের প্রিন্ট আউট নিয়ে বসলেন। কিন্তু কোনও উপায় তাঁর মাথায় এল না।
প্রতিভা বললেন, “অত ভেবো না। খেয়ে নাও। তারপর বিশ্রাম করো। মাথা ঠাণ্ডা না হলে বুদ্ধি খেলবে কী করে?”
ভরদুপুরে যখন পাড়া সুনসান তখন হঠাৎ ডোরবেল শুনে প্রতিভা উঠলেন। জেট ল্যাগ-এর ক্লান্তি ছিল। সতর্ক হওয়ার কথা খেয়াল
করেই গিয়ে দরজাটা খুললেন। আর সঙ্গে-সঙ্গে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। তাঁর সামনে পাঁচজন সশস্ত্র লোক দাঁড়িয়ে।
প্রতিভাকে রূঢ় একটা ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে তারা ঘরে ঢুকল। তারপর ঠেলে তুলল বাবুরামকে বনিকে নির্দয় হাতে বিছানা থেকে তুলে একটা চাঁদরে পুঁটুলির মতো বেঁধে ঝুলিয়ে নিল। প্রতিভার কান্নাকাটি চিৎকারে কর্ণপাতও করল না। পিস্তল বুকে ঠেকিয়ে বলল, “চলো, তোমাদেরও যেতে হবে।”
বাবরামের ইচ্ছে করছিল নিজের গালে চড় কষাতে। এ বাড়িতে ওঠা যে কত বড় ভুল হয়েছে। এখন আর কিছুই করার নেই। তীরে এসে তরী ডুবল।
বাবুরাম শুধু চেষ্টা করলেন, পানচোকে সঙ্গে নিতে। কিন্তু দেখলেন সেটা জায়গায় নেই।
কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে তাঁদের একটা প্রকাণ্ড গাড়ির ভিতরে তুলে গাড়ি ছেড়ে দিল গুণ্ডারা। বাবুরাম আর প্রতিভা নির্বাক হয়ে বসে রইলেন।
যখন তাঁরা পোর্টল্যাণ্ডে ঢুকলেন তখনও রোদ রয়েছে। চারদিকে আলো। শুধু প্রতিভা আর বাবুরামই চোখে অন্ধকার দেখছেন।
একটা নির্জন শহরতলির বনভূমি পেরিয়ে অনেকটা যাওয়ার পর এক বিশাল চত্বর জুড়ে চমৎকার একখানা ক্লিনিকের বাড়িঘর নজরে পড়ল। ভিতরে অজস্র বাগান, ফোয়ারা, ডিয়ার পার্ক, খেলার মাঠ। কয়েক মাইল নিয়ে ক্লিনিক।
গাড়ি একটা টিলার গায়ে চওড়া সুড়ঙ্গের ভিতরে ঢুকে গেল। সুড়ঙ্গটি আলোয়-আলোয় ছয়লাপ। যেখানে এসে গাড়ি থামল সেটি একটি ভূগর্ভের বাড়ি। এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর এত আলোর ব্যবস্থা যে, বিশ্বাসই হতে চায় না এখানে এক নারকীয় পরিকল্পনার ষড়যন্ত্র আঁটা হচ্ছে।
লোকগুলো খুবই চটপটে। তাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে প্রায় ছাগল তাড়ানোর মতো ডিয়ে একটা ঘরে এনে ঢুকিয়ে দিল। বনিকে পুঁটলি করে কোথায় নিয়ে গেল কে জানে। প্রতিভা দৌডে গিয়ে দরজা টানাটানি করলেন, কিন্তু দরজা লক হয়ে গেছে।
বাবুরাম চারদিকে চেয়ে দেখলেন, এ-ঘরটি একটি জানালাহীন গর্ভগৃহ। যদিও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এবং আলো ঝলমল, তবু অনেকটা বন্দীনিবাসের মতোই মনে হচ্ছে।
প্রতিভা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “কী হবে এবার?”
বাবুরাম মাথা নেড়ে বললেন, “সব শেষ।”
প্রতিভা ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন, “বনিকে ওরা কি মেরে ফেলবে?”
“সেটাই সম্ভব প্রতিভা।”
“আর আমরা?”
“সান্ত্বনা এই যে, বনির পর আমাদেরও বাঁচিয়ে রাখবে না।”
প্রতিভা কাঁদতে লাগলেন। বাবুরাম চোখ ঢেকে বসে রইলেন। কিছু করার নেই।
কতক্ষণ এভাবে কাটল কে জানে, হঠাৎ কোনও গুপ্ত মাইক্রোফোন থেকে কেউ বলল, মিস্টার এবং মিসেস গাঙ্গুলি, কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত, তবে আপনারা আমাদের মহা মূল্যবান গবেষণার তাৎপর্য না বুঝে বোকার মতো এমন অনেক কাজ করেছেন, যা সভ্যতার পক্ষে ক্ষতিকারক। বনিকে মারবার কোনও ইচ্ছে আমাদের ছিল না। কিন্তু আপনারা বোধ হয় জেনে গেছেন যে, তার মগজের মাইক্রোচিপ ঠিকমতো সেট হয়নি। কোথায় গণ্ডগোল হল তা দেখার জন্য তার মগজ আমাদের তন্ন-তন্ন করে দেখতে হবে। কিন্তু তার মৃত্যু ভবিষ্যতে বৃহত্তর গবেষণায় প্রচুর সাহায্য করবে। বনির মৃত্যু মহান। আপনারা যদি অপারেশনটি দেখতে চান তা হলে দরজা খুলে বেরিয়ে বাঁ দিকে এগোলেই লিফট পাবেন। লিফট আপনাদের একটা অবজারভেশন গ্যালারিতে নিয়ে আসবে। সেখান থেকে সবই দেখতে পাবেন।
বাবুরাম চেঁচিয়ে বললেন, “আমাদের এখানে ধরে রেখেছেন কেন?”
“আপনারা বিপজ্জনক। দুঃখিত, আপনাদের রেহাই দেওয়ার কোনও উপায় নেই।”
প্রতিভা বাবুরামের হাত চেপে ধরে বললেন, “চলো, আমার ছেলেকে শেষবারের মতো দেখে আসি। আর তো ইহলোকে দেখা হবে না।”
বাবুরাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “চলো৷”
এবার দরজা টানতেই খুলে গেল। করিডোর পেরিয়ে বাবুরাম আর প্রতিভা টলতে-টলতে লিফটে এসে উঠলেন। নিঃশব্দে লিফট তাদের নিয়ে এসে একটা ঘরে হাজির করল। অর্ধচন্দ্রের মতো সুন্দর ঘর। বাঁকা দেওয়ালটা পুরোপুরি স্বচ্ছ কাঁচে তৈরি। সেখানে বসবার জন্য আরামদায়ক সোফাসেট রয়েছে।
কাঁচের ভিতর দিয়ে মাত্র আট দশ ফট নীচে দেখা যাচ্ছে বিরাট একটা অপারেশন থিয়েটার। সেখানে হাজারো ছোটবড় যন্ত্রপাতি। কয়েকজন সাদা পোশাক পরা মুখ-ঢাকা মানুষ ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘোরাফেরা করছে। মাঝখানে অপারেশন টেবিলের ওপর বনি শুয়ে আছে।
প্রতিভা কাঁচের গায়ে কিল মারতে মারতে পাগলের মতো চেঁচাতে লাগলেন, “বনি! বনি! বনি! বনি!”