স্ক্রিনটা হঠাৎ সাদা হয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে একটা বাক্য ফুটে উঠল, “খুব সাবধান।”
.
চি চেং ওরফে পানচোকে গদাইবাবুর হাতে ফেরত দেওয়া উচিত হবে কি না তা বাবুরাম বুঝতে পারছিলেন না। তবে সন্ধের দিকে তিনি গদাইবাবুর বাড়ি গেলেন। গিয়ে দেখলেন, ঘোর লোডশেডিং এবং গদাইবাবুর বাড়িও অন্ধকার।
তাঁকে দেখে গদাইবাবু আহ্লাদে একেবারে বিগলিত হয়ে বললেন, “ধন্য মশাই আপনি। কী একটু কলকাঠি নেড়ে গেলেন আর অমনি আমার বাড়িতে আবার আগের পরিস্থিতি ফিরে এসেছে।”
“আপনি কি তাতে খুশি?”
“খুব খুশি মশাই, খুব খুশি। যা ভুতুড়ে কাণ্ড শুরু হয়েছিল তাতে তো আমার হাত-পা সব পেটের মধ্যে সেঁদিয়ে যাওয়ার জোগাড়।”
“পানচোকে কি আপনি ফেরত চান গদাইবাবু?”
“দূর দূর। টাকাটাই গচ্চা গেছে। ও আর চাই না। জঙ্গল দূর হওয়াই ভাল।”
৬. চার দিন বাদে মুখে দুশ্চিন্তা
চার দিন বাদে মুখে দুশ্চিন্তা এবং শরীরে ক্লান্তি নিয়ে এয়ার ইণ্ডিয়ার জাম্বো জেট থেকে এক বিকেলে নিউ ইয়র্কের জে এফ কে বিমানবন্দরে নামলেন বাবুরাম এবং বনিকে কোলে নিয়ে প্রতিভা।
প্রতিভাকে রেখে-ঢেকে সবই প্রায় বলেছেন বাবুরাম। শুধু বনির প্রসঙ্গটা চাপা দিয়ে বনির জবানিতে যা জেনেছেন সেটা চাপিয়েছেন চি চেং তথা পানচোর ঘাড়ে। প্রতিভা পুরোপুরি বিশ্বাস করেননি। তবে বনির ভালর জন্য সবকিছু করতেই তিনি রাজি। তাই তাঁদের পক্ষে বিপজ্জনক আমেরিকাতেও ফিরে আসতে সম্মত হয়েছেন।
চি চেং-কে সঙ্গেই এনেছেন বাবুরাম। মস্ত বড় সুটকেসে জামা কাপড়ের সঙ্গেই তাকে ভরে লাগেজে দিয়েছিলেন। মালপত্র যখন এক্স-রে করা হচ্ছিল তখন বাবুরামের ভয় ছিল, পানচো ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু অবাক কাণ্ড, পানচোর ছবি এক্স-রে মেশিনে ধরা পড়েনি।
প্রতিভা বললেন, “শোনো, নিজেদের বাড়ি থাকতে হোটেলে ওঠাটা আমার পছন্দ নয়।”
বাবুরাম সবিস্ময়ে বললেন, “নিজেদের বাড়িতে উঠব! সর্বনাশ। শয়তানরা যে ওত পেতে থাকবে সেখানে!”
প্রতিভা শান্ত গলায় বললেন, “আমার তো ভয় করছে না। আমাদের সঙ্গে পানচো আছে।”
“পানচো!” বলে বাবুরাম একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, “ঠিক আছে। চলো, বাড়িতেই যাই। বাড়ি যেতে ইচ্ছেও করছে আমার।”
ট্যাক্সি নিয়ে তাঁরা জার্সি সিটির বাড়িতে এলেন। তারপর ঘরদোর পরিষ্কার করা, বাজার করা, রান্না খাওয়া ইত্যাদিতে সময় চলে গেল। রাত্রিবেলা পানচোকে বেসমেন্টে নিয়ে গেলেন বাবুরাম। সঙ্গে বনি এবং প্রতিভাও বেসমেন্টে বাবুরামের নিজস্ব অত্যাধুনিক ব্যক্তিগত
কমপিউটার আছে। কমপিউটারের মাধ্যমে বনির সঙ্গে বাবুরামের কথা হতে লাগল।
“বনি, আমরা ফের আমেরিকায় এসেছি।”
“বুঝতে পারছি।”
“তোমার কেমন লাগছে?”
“ভাল।”
“বনি, মাদার কমপিউটারকে টের পাচ্ছ?”
“পৃথিবীর যেখানেই যাই না কেন, মাদার কমপিউটার আমাকে নিয়ন্ত্রণ করবেই।”
“তুমি কি মাদার কমপিউটারকে পছন্দ করো?”
“কিছুটা করি। কিন্তু মাঝে-মাঝে…”
“মাঝে-মাঝে কী বনি?”
“মাঝে-মাঝে কী একটা গণ্ডগোল হয়ে যায়।”
“যদি মাদার-কমপিউটার ধ্বংস হয়ে যায় তা হলে কি তুমি দুঃখ পাবে?”
“দুঃখ! না, ওসব আমার হয় না। তবে হয়তো আমিও ধ্বংস হয়ে যাব।”
“না, বনি, তুমি ধ্বংস হলে আমি কিছু করব না। একটা কথা বলব তোমাকে?”
“বলো।”
“মাদার কমপিউটারের চেহারাটা দেখতে চাই।”
“সঙ্গে-সঙ্গে পরদায় গ্র্যাণ্ড পিয়ানোর মতো চেহারার একটা রেখাচিত্র ফুটে উঠল। তারপর দেখা গেল পরিষ্কার একটা রঙিন ফোটো।”
“বাবুরাম কমপিউটারের একজন বিশেষজ্ঞ। অনেকক্ষণ ধরে তিনি ছবিটা দেখলেন। তারপর বললেন, “বনি, আমি এর ট্রাইডেম চেহারা দেখতে চাই। পারবে দেখাতে?”
সঙ্গে-সঙ্গে ছবি ঘুরে চতুর্দিক থেকে কমপিউটারকে দেখাতে লাগল।
“তুমি এর ভিতরকার সার্কিটগুলোর প্ল্যান জানো?”
“সঙ্গে-সঙ্গে কমপিউটারের অভ্যন্তরে জটিল সব যন্ত্রপাতি ফুটে উঠল পরদায়। ডক্টর লিভিংস্টোন নিশ্চয়ই এত বোকা নন যে, তাঁর এই মূল্যবান কমপিউটারের সব তথ্য তাঁর দাসদের জানিয়ে রাখবেন। এটা যে সম্ভব হচ্ছে পানচো তথা চি চেং-এর জন্যই তা বুঝতে বাবুরামের লহমাও লাগল না।
“বনি, আমি কমপিউটারটার সব রকম প্রিন্ট-আউট চাই।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই স্লট দিয়ে অন্তত পনেরোখানা প্রিন্ট-আউট বেরিয়ে এল।
বাবুরাম সারা রাত জেগে সেগুলো খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন।
সকালবেলায় তিনি হাসপাতালে টেলিফোন করে ডক্টর ওয়াং-এর অবস্থা জানতে চাইলেন।
হাসপাতাল বলল, অবস্থা ভাল নয়। তাঁকে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হয়েছে।
বাবুরাম ফোন রেখে দিলেন। তারপর অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলেন। কী করবেন, কোন প্ল্যানমাফিক এগোবেন তা বুঝতে পারছেন না।
ব্রেকফাস্ট খেয়ে তিনি গাড়ি নিয়ে সোজা গিয়ে হাজির হলেন ভবঘুরেদের আস্তানায়। তাঁকে দেখে সবাই বেরিয়ে এসে ঘিরে ধরল। বাবুরাম তাদের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলেন, ওদের দুজন ওয়াংকে বাঁচাতে গিয়ে খুন হওয়ায় ওরা ভীষণ ক্ষুব্ধ। তবে রাগটা ওয়াং-এর ওপর নয়, খুনেদের ওপর।
ফ্রেড বলল, “আমাদের কাছে অস্ত্র নেই। থাকলে এত দিনে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতাম।”
বাবুরাম ওদের শান্ত হতে খানিকটা সময় দিলেন। তারপর সকালের কথা থেকে যা বুঝতে পারলেন তা হল, তিনি আর প্রতিভা বনিকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই ওয়াং এদের কাছে আসেন এবং আমেরিকায় নতুন ধরনের যান্ত্রিক দাস তৈরি করার ষড়যন্ত্রটি ওদের বুঝিয়ে বলেন। পোর্টল্যাণ্ডের ডক্টর লিভিংস্টোনের ক্লিনিকটিই যে এই ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রস্থল তাও জানান। পুলিশ বা সরকার যে আইনের পথে এদের কিছু করতে পারবে না তাতেও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু বুদ্ধিমান ওয়াং যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন সেটিই ছিল বোকার মতো। তিনি তাঁর তিনজন সঙ্গী এবং ভবঘুরেদের জনা-পাঁচেককে নিয়ে একটা দল গড়েন এবং সেই দল নিয়ে পোর্টল্যান্ডে গিয়ে লিভিংস্টোনের ক্লিনিকটি ঝটিতি দখল করার চেষ্টা করেন। উত্তেজনার মাথায় এ-কাজ করতে গিয়ে তাঁরা সহস্র প্রহরীদের পাল্লায় পড়ে যান। কয়েকজন পালাতে পারলেও যা। ঘটবার তা ঘটে গেছে।