সংবাদ শেষ হয়ে গেল।
বাবুরাম বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মনটা ভরে গেল বিষণ্ণতায়। পোর্টল্যাণ্ডে কেন গিয়েছিলেন ওয়াং? তবে কি ডক্টর লিভিংস্টোনের ক্লিনিকেই আছে মানুষকে যান্ত্রিক দাস বানানোর কারখানা? ওয়াং কি ভীমরুলের চাকে ঘা দিয়েছিলেন? চি চেং এবং বনির নামই বা তিনি করছেন কেন বিকারের ঘোরে? এই দুইয়ের মধ্যে কি কোনও সম্পর্ক আছে? চি চেং হল ওয়াং-এর সেই আবিষ্কার যা চুরি হয়ে গেছে। নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল বাবুরামের। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে ওয়াং অনেক ঝুঁকি নিয়েছেন।
গদাইবাবু শুকনো মুখে বললেন, “কিছু বুঝতে পারছেন বাবুরামবাবু?”
বাবুরান অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, “না। ব্যাপারটা খুবই রহস্যময়। তবে আমি আগামীকাল আবার আসব। সব কিছু খুঁটিয়ে দেখতে হবে।”
.
পর দিন বাবুরাম সকালের ডাকে একটা চিঠি পেলেন। বারো দিন আগে নিউ ইয়র্ক থেকে পোস্ট করা ডক্টর ওয়াং-এর চিঠি। ইংরেজিতে টাইপ করা চিঠিতে ওয়াং লিখেছেন, আপনি এত দিনে নিরাপদে দেশে পৌঁছে গেছেন আশা করছি। দয়া করে বনির কোনও চিকিৎসা করাতে যাবেন না, তাতে ওর ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। যে দুষ্টচক্র বিশ্বব্যাপী নিজেদের যান্ত্রিক দাস তৈরি করার পরিকল্পনা করেছে তাদের সম্পর্কে আরও কিছু খোঁজখবর পেয়েছি। বনির মতো আরও কিছু শিশুকে মাতৃগর্ভেই এরা যান্ত্রিক আজ্ঞাবহ দাস বানানোর পথে অনেকটা এগিয়ে গেছে। ওদের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখনও শতকরা একশো ভাগ সফল নয়। কিন্তু আমার ভয়, এরা অচিরেই সফল হবে। তার ফলে কী হবে জানেন? হাজার হাজার মানুষকে এরা রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে চালাবে, যা খুশি করিয়ে নেবে। হয়তো নরহত্যা, চোরাই চালান, হাইজ্যাকিং, টেররিজম। আর এইসব যান্ত্রিক দাসেরা হবে খুব বুদ্ধিমান, সাঙ্ঘাতিক মেধাবী, অসম্ভব ক্ষিপ্র ও শক্তিশালী। এদের কোনও নৈতিক বোধ বা চরিত্র থাকবে না, থাকবে না নিজস্ব কোনও চিন্তাধারা বা আদর্শ, থাকবে না স্নেহ ভালবাসা প্রেম বা দুর্বলতা। এসব ভেবে ভয়ে আমি শিউরে শিউরে উঠছি। ভাবছি যদি আজ আমার হাতের কাছে চি চেং থাকত, হয়তো সে আমাকে উপায় বাতলে দিতে পারত। চি চেং এক আশ্চর্য জিনিস। সে না করতে পারে হেন কাজ নেই। হায়, সে আজ কোথায়?….
চিঠিটা পড়তে-পড়তে বাবুরামের চোখ ঝাঁপসা হয়ে এল চোখের জলে।
একটু বেলায় বাবুরাম গদাইবাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। এই বাড়ির রহস্যটাও তাঁকে ভীষণভাবে ভাবাচ্ছে। কোনও ব্যাখ্যাই তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না।
গদাইবাবু আজ অফিস কামাই করে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বিগলিত মুখে অভ্যর্থনা করে বললেন, “আসুন গাঙ্গুলি-সাহেব, আসুন। আপনিই এখন আমার শেষ ভরসা।”
বাবুরাম টিভি সেটটা খুলে তন্ন-তন্ন করে দেখলেন। অত্যন্ত সাধারণ সাদা কালো সেট। কোনও বৈশিষ্ট্য বা অসাধারণত্ব নেই। সারা বাড়ি ঘুরে-ঘুরে দেখতে-দেখতে তাঁরা ছাদে এলেন।
গদাইবাবু একজন বিজ্ঞানীকে কাছে পেয়ে নিজের ল্যাবরেটরিটা দেখানোর লোভ সামলাতে পারলেন না। চিলেকোঠার দরজাটা খুলে দিয়ে সগর্বে বললেন, “বাবুরামবাবু, আমি বিজ্ঞানী নই বটে, কিন্তু খুব বিজ্ঞান-মাইণ্ডেড। এই দেখুন, আমিও একটু চচা-টচা করে থাকি।”
বাবুরাম গদাইবাবুর ল্যাবরেটরি দেখে হাসলেন। তবে ভদ্রতাবশে সব-কিছুই খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। হঠাৎ তাকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওটা কী বস্তু গদাইবাবু?”
গদাইবাবু বললেন, “ব্যাটারা ঠকিয়ে দিয়েছে মশাই। মিস্টিরিয়াস মিস্টার পানচো নামের একটা সায়েন্স কিট নিয়ে এলুম। তার কোনও মাথামুণ্ডুই বুঝলুম না। এখন পড়ে আছে।”
বাবুরাম তাক থেকে পানচোকে নামিয়ে এনে ভাল করে দেখলেন। তাঁর ভ্রূ কুঁচকে গেল চিন্তায়। বললেন, “কোথায় পেলেন এটা?”
“আজ্ঞে চিনে-বাজারে।”
“জিনিসটা কোনও কাজেই লাগেনি?”
“না। আপনি নিয়ে গিয়ে দেখতে পারেন কোনও কাজ হয় কি।”
বাবুরাম পানচোকে ভাল করে পরীক্ষা করলেন ফের। একটা ব্যারেল আর কয়েকটা ধাতব হাত বা স্ট্যাণ্ড। তবে স্ট্যাণ্ডগুলোর গড়ন দেখে মনে হচ্ছে, সেগুলির ভিতর সম্মু যন্ত্রপাতি থাকতে পারে। বাবুরাম ব্যারেলের গায়ে কান পাতলেন। অনেকক্ষণ কান পেতে তাঁর মনে হল, ব্যারেলের ভিতরে একটা অতি ক্ষীণ স্পন্দন বা ভাইব্রেশন হয়ে চলেছে।
বাবুরাম জিনিসটা খবরের কাগজ দিয়ে ভাল করে মুড়ে নিলেন।
বাড়ি ফিরে তিনি সোজা দোতলার একটা অব্যবহৃত ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে দিলেন। তারপর পানচোকে কাগজের মোড়ক থেকে বের করে উলটে-পালটে দেখতে লাগলেন।
হঠাৎ আপন মনেই বাবুরাম ইংরেজিতে বলে উঠলেন, “টু নো দিস টয় আই নিড এ কমপিউটার।”
পানচোর ব্যারেলের মধ্যে একটা শিস টানার মতো শব্দ হল। বাবুরাম নীচে গিয়ে বাড়ির টিভি সেটটা নিয়ে এলেন। গদাইবাবুর বাড়িতে যা ঘটেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, সাধারণ টিভি সেটকে কমপিউটর ডিসপ্লে স্ক্রিনে পরিণত করা পানচোর পক্ষে কঠিন হবে না। তবে কোনও কি-বোর্ড নেই বা ডাটা ফিডমেন্টের উপায় দেখছেন না।
বাবুরাম কী করবেন ভাবছেন। এমন সময় আচমকা টিভির পরদায় অক্ষর ফুটে উঠতে লাগল। প্রথমেই ফুটে উঠল, “আই অ্যাম অলসো এ কমপিউটার।”
বাবুরাম বুঝলেন, ডাটা ফিডমেন্টের প্রয়োজন নেই, তাঁর কথা পানচো বুঝতে পারছে।