ওয়াং মৃদুস্বরে বললেন, “এরা সব আমার চ্যালা। জরুরি পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য এদের বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়েছি আমি। আমেরিকান গুণ্ডারা ঘুসি আর ছোরাঘুরি আর পিস্তল ছাড়া কিছুই জানে না। বড় ক্রুড। বিজ্ঞানের যুগে কতরকম উপকরণ বেরিয়ে গেছে, এরা সেসব গ্রাহই করে না। দেখলে তো, তিনটে রোগাপটকা চিনার কাছে কেমন নাকাল হল চার-চারটে দশাসই আমেরিকান!”
এত দুঃখেও একটু হাসলেন প্রতিভা। বললেন, “আপনি না থাকলে কী যে হত!”
বাবুরাম চোখ মেললেন, কাতর শব্দ করলেন, তারপর উঠে বসে বললেন, “আমার চোয়াল বোধহয় ভেঙে গেছে।”
ওয়াং মৃদু হেসে বলেন, “না মিস্টার গাঙ্গুলি। আপনার শরীরে ষাঁড়ের মতো ক্ষমতা আছে। যাকগে, লড়াই শেষ হয়েছে। মনে হচ্ছে আর বিপদ ঘটবে না। পুলিশও এসে গেছে। আর দেরী না করে লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ুন। ভাবখানা এমন করবেন যেন কিছুই হয়নি।”
বাবুরাম দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বললেন, “সবকিছুর জন্যই। আপনাকে ধন্যবাদ। আমরা কৃতজ্ঞ।”
ওয়াং সংক্ষেপে যা বললেন, তার অর্থ, সব ভাল যার শেষ ভাল। বাবুরাম আর প্রতিভা লাইনে গিয়ে দাঁড়ালেন। হাতে পাশপোর্ট, টিকিট। হই-হট্টগোলে তাঁদের কেউ আলাদা করে লক্ষ করল না।
.
আতঙ্কিত, বিধ্বস্ত, ক্লান্ত অবস্থায় বাবুরাম আর প্রতিভা যখন কলকাতায় পৌঁছলেন তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। তবে কলকাতার মাটিতে পা রেখে তাঁরা স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। হঠাৎ এসেছেন বলে
তাঁদের নিয়ে যেতে কেউ বিমানবন্দরে আসেনি।
মালপত্র বলতে তাঁদের সঙ্গে সামান্যই জিনিস। কাস্টমস পেরিয়ে তাঁরা একটা প্রি-পেইড ট্যাক্সি নিলেন। বাড়ির দরজায় যখন এসে নামলেন তখন ঘুটঘুট্টি লোডশেডিং-এর অন্ধকার চারদিকে।
বাড়ির লোক খেয়ে-দেয়ে ঘুমোনোর আয়োজন করছিল। তাঁদের আগমনে সারা বাড়ি আনন্দে বিস্ময়ে ফের জেগে উঠল। বাবুরামের বাবা বলাইবাবু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তিনিও প্রায় লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন। তাঁর নাতি এসেছে যে!
৫. সায়েন্স দিয়ে সবকিছুকে ব্যাখ্যা
সায়েন্স দিয়ে সবকিছুকে ব্যাখ্যা করতে পারছেন না গদাইবাবু। দিন-দিন শুকিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে লোডশেডিং-এ তাঁর বাড়িতে আলো জ্বলে এবং তাঁর সাদা কালো টিভি-তে এন বি সি বা বি বি সি’র রঙিন সম্প্রচার দেখা যায়–এসবের জন্য তাঁর বাড়িতে আজকাল সন্ধেবেলায় বেশ ভিড় হচ্ছে। অনেকেই দেখতে আসছে কাণ্ডটা।
সি ই এস সি’র লোকেরাও এসে তাঁর বাড়ির লাইন পরীক্ষা করে বলেছে, না কোনও হট লাইনের সঙ্গে তাঁর বাড়ির তার জড়িয়ে যায়নি। তবু কেন কারেন্ট না থাকলেও আলো জ্বলে তা তারা বুঝতে পারছে না।
গদাইবাবুর সম্বন্ধি গজেন এক দিন হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, “শোনো গদাই, আমাদের পাশের বাড়িতে একজন মস্ত ইলেকট্রনিক্সের এঞ্জিনিয়ার এসেছে। দেড় গজ লম্বা তার টাইটেল। আমেরিকায় একটা বড় ফার্মের চিফ ইলেকট্রনিক্স এঞ্জিনিয়ার। বছরে দেড় লাখ ডলার মাইনে। তাকে কালই ধরে এনে তোমার বাড়ির লাইন দেখাব। সন্ধের পর থেকে। সে আসতে রাজি হয়েছে।”
গদাইবাবু উদাস গলায় বললেন, “যা ভাল হয় করুন।”
পরদিন সন্ধেবেলা যাকে নিয়ে এল গজেন তাকে দেখে গদাইবাবুর বড় চেনা-চেনা ঠেকতে লাগল। এ-মুখ যেন দেখেছেন কোথাও। নামটা শুনেই লাফিয়ে উঠলেন গদাইবাবু, “আপনিই বাবুরাম গাঙ্গুলি? বনির বাবা! আপনাকে এন বি সি’র নিউজ চ্যানেলে দেখেছি।”
বাবুরাম অবাক হয়ে বললেন, “এন বি সি! আপনি কি রিসেন্টলি আমেরিকায় গিয়েছিলেন?”
“না। কস্মিনকালেও যাইনি।”
“তা হলে কি এন বি সি’র ভিডিও ক্যাসেট দেখেছেন?”
“না। আমার ভি সি আর নেই।”
“তা হলে?”
গদাইবাব আমতা-আমতা করে বললেন, “ওই আর কি। আসলে কী জানেন, আমার বাড়িতে অদ্ভুত সব কাণ্ড হচ্ছে। তার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। এন বি সি চ্যানেল আমি এই টিভিতেই দেখেছি।”
“কিন্তু এ তো অর্ডিনারি টিভি! কলকাতার প্রোগ্রামই তো দেখাচ্ছে।”
“হ্যাঁ। কিন্তু মাঝে-মাঝে…”
বলতে বলতেই গদাইবাবুর টিভি রঙিন হয়ে গেল। স্পষ্ট চলে এল এন বি সি’র প্রাতঃকালীন সংবাদ। বাবুরাম স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইলেন। এরকম হওয়ার কথা নয়। এ এক অসম্ভব কাণ্ড। মার্কিন টিভির প্রোগ্রাম কী করে কলকাতায় দেখা যাচ্ছে!
খবরে যে ঘটনাটি একটু বাদেই শুনলেন বাবুরাম তাতে আরও বিস্মিত এবং হিম হয়ে গেলেন। সংবাদ-পাঠক জানালেন, পোর্টল্যাণ্ডে একটি জঙ্গলের ধারে ডক্টর ওয়াং-কে সাঙ্ঘাতিক আহত অবস্থায় পাওয়া যায়। ওয়াং বিশ্ববিখ্যাত চিনা বৈজ্ঞানিক সম্প্রতি তিনি দেশ থেকে পালিয়ে মার্কিন দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কিন্তু লণ্ডন থেকে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তারপরই তাঁকে এই অবস্থায় পাওয়া যায়। কয়েকজন ভবঘুরে তাঁকে উদ্ধার করে নিউ ইয়র্কের হাসপাতালে নিয়ে আসে। ওদিকে চিন সরকার জানিয়েছেন যে, ইনি আসল ডক্টর ওয়াং নন। ডক্টর ওয়াং-এর উদ্ধারকারীদের একজনের জবানিতে শুনন। ইনি ফ্রেড মেইলার…. বলতে-বলতেই ফ্রেড-এর চেহারা ভেসে উঠল পরদায়। সেই পোশাক, সেই টুপি। ফ্রেড থেমে-থেমে বলল, “ডক্টর ওয়াং অত্যন্ত ভাল লোক। তাঁকে আমরা চিনতাম। পোর্টল্যাণ্ডে তিনি একটি বিশেষ অভিযানে গিয়েছিলেন। তাঁর অভিযান ছিল কিছু দুষ্ট লোকের বিরুদ্ধে। আমাদের বিশ্বাস, ডক্টর ওয়াং-কে ওই শয়তানেরা আবার মারবার চেষ্টা করবে।”… ফ্রেড-এর ছবি কেটে দিয়ে সংবাদ-পাঠক বললেন, “ডক্টর ওয়াং-এর জ্ঞান না থাকলেও তিনি মাঝে-মাঝে দু-চারটে শব্দ বারবার উচ্চারণ করছেন। তার মধ্যে একটা হল চি চেং। আর একটা বনি। বাহাত্তর ঘণ্টা না কাটলে ডক্টর ওয়াং-এর বাঁচবার সম্ভাবনা সম্পর্কে ডাক্তাররা কিছুই বলতে পারবেন না। দুটি গুলি তাঁর ঊরুতে লেগেছে, একটি ঘাড়ে। তাঁর গায়ে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট থাকায় হৃৎপিণ্ডে বা ফুসফুসে কোনও গুলি লাগেনি। তবে দুঃখের বিষয় ডক্টর ওয়াং-এর সঙ্গী দু’জন ভবঘুরে এবং একজন চিনা নিহত হয়েছেন।”