বাবুরাম সম্বিৎ ফিরে পেয়ে প্রতিভার কানে কানে বললেন, “আমার পিঠে পিস্তলের নল। বাইরে যেতে বলছে। কী করব প্রতিভা?”
প্রতিভা শান্ত গলায় বললেন, “এ যা বলছে তাই করতে হবে। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রাখো আর আমার পিছনেই থেকো।”
প্রতিভা বনিকে কোলে নিয়ে ধীর পায়ে লাইন থেকে বেরিয়ে এলেন, “তারপর দরজার দিকে এগোতে লাগলেন। পিছনে বাবুরাম। তার পিছনে সেই লোকটি।”
দরজার কাছ বরাবর যেতেই ব্যস্তসমস্ত এক যাত্রী মালের ট্রলি নিয়ে দরজা দিয়ে ঢুকলেন। ট্রলিতে বেশ বড় বড় দুটো স্যুটকেস, ব্যাগ, ছাতা ইত্যাদি। লোকটি ট্রলিটা নিয়ে হুড়মড় করে ঢুকেই সোজা যেন বাবুরামের ঘাড়েই এসে পড়ছিলেন। বাবুরাম সরে দাঁড়ালেন। কিন্তু লোকটা প্রায় উন্মাদের মতো ট্রলিটার একটা প্রবল ধাক্কা দিয়ে কনুইয়ের তোয় বাবুরামকে ছিটকে দিলেন।
একটা “ওঃ গড!” চিৎকার শোনা গেল। বাবুরাম সামলে উঠে পিছন ফিরে দেখলেন তাঁর অনুসরণকারী লম্বা লোকটা হাঁটু চেপে ধরে মেঝের ওপর বসে আছে। চোখে-মুখে বোকার মতো ভাব। যাত্রীটি নিচু হয়ে বারবার ক্ষমা চাইছে লোকটার কাছে, বড় তাড়াহুড়োয় তোমাকে জখম করে ফেলেছি। কিছু মনে কোরো না…
বলতে বলতে যাত্রীটি লোকটার বগলের তলায় হাত দিয়ে তাকে তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু বাবুরাম স্পষ্ট দেখলেন যাত্রীটির হাতে একটি চাকতির মতো কী জিনিস যেন। আহত লোকটা একবার উঠবার চেষ্টা করতে গিয়ে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে গেল।
এই গণ্ডগোলে হঠাৎ বাবুরাম দেখতে পেলেন, চার-পাঁচটা লোক এসে জলদিবাজ যাত্রীটিকে ঘিরে ফেলেছে। তাদের চেহারা বা হাবভাব সুবিধের নয়। যাত্রীটি হাত-পা নেড়ে কী যেন বোঝানোর চেষ্টা করছে তাদের। লোকটা ওয়াং নন। তবে তাঁর শাকরেদ হতে পারে।
বাবুরাম প্রতিভার দিকে চেয়ে বললেন, “ফিরে এসো। বোধ হয় এ যাত্রা বেঁচে যাব।”
“ও লোকটা কে?”
“চিনি না।”
“ইচ্ছে করে এরকম করল নাকি?”
“তাই তো মনে হচ্ছে।”
“ তা হলে কিন্তু তোমার উচিত ওকেও সাহায্য করা। ওই দ্যাখো, কতগুলো লোক ওকে কেমন ঘিরে ধরেছে।”
বাবুরামের মনে হল, প্রতিভা ঠিকই বলেছে। লোকটা যদি তাঁদের বাঁচানোর জন্যই ওই কাণ্ড করে থাকে তাহলে বাবুরামেরও উচিত। লোকটার সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া।
বাবুরাম কখনও মারপিট করেননি। বরাবর ভাল ছেলে ছিলেন। তবে খেলাধুলা করতেন। এখনও জগিং করেন, দু-চারটে আসনও। গায়ে তাঁর জোর আছে কি না তা তিনি জানেন না। এ সুযোগে একটা পরীক্ষা হয়ে যাক।
তিনি এগিয়ে যেতে যেতেই দেখলেন, দানবাকৃতি পাঁচটা লোক প্রায় ঠেসে ধরে যাত্রীটিকে পায়ে পায়ে দরজার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। বাবুরাম চিন্তাভাবনা না করেই সামনে যে পড়ল সোজা তার মাজায় নিজের বুটসুষ্ঠু পা সজোরে বসিয়ে দিলেন।
বলতেই হবে মারটা বেশ জোরালোই হল। লোকটা লাথির চোটে ছিটকে পড়ে গেল। আর বাকি চারটে লোক এত অবাক হয়ে বাবুরামের দিকে তাকাল যে, বলার নয়।
ভূপাতিত লোকটার বিশেষ লাগেনি। মারটার খেয়ে এরা বেশ তৈরি হয়ে গেছে। লোকটা এক লাফে উঠে এসে বাবুরামের মুখে একটা ঘুসি চালিয়ে দিল। বাবুরাম খানিকটা শূন্যে উঠে চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে দড়াম করে আছড়ে পড়লেন। লোকটা বাবুরামকে লাথি মারতে পা তুলেছিল, এমন সময় মশার কামড়ের মতো কিছু বিধল বোধ হয় তার ঘাড়ে। কেমন যেন বিহুলের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তারপর ধীরে-ধীরে ভেঙে পড়ে গেল।
অন্য চারজন ধৃত লোকটিকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তাড়াতাড়ি এসে প্রতিভাকে পাকড়াও করল টেনে নিয়ে যেতে লাগল দরজার দিকে।
কিন্তু এ-সময়ে দরজাটা জ্যাম করে দু-দুটো মালের ট্রলি এসে এমন আটকে গেল যে, কিছুতেই ছাড়ানো যায় না দুটোকে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।
দু’জন চিনা যাত্রী এই কাণ্ডের জন্য সকলের কাছে প্রচুর ক্ষমা চাইতে লাগলেন। কিন্তু তাতে পথ পরিষ্কার হল না। চারটে গুণ্ডা খেপে গিয়ে দমাদম ট্রলি থেকে মালপত্র তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে লাগল। তাদের ধাক্কায় যাত্রীরাও ছিটকে যাচ্ছে এদিক-ওদিক ছুটে এল সিকিউরিটির লোকেরা। আর এই গণ্ডগোলে লাল জড়লওলা বেঁটেমতো একটা লোক একটু দূরে দাঁড়িয়ে শান্তমুখে একটু হাসল।
আগন্তুক চিনা, যাত্রী দুজনের মাল গুণ্ডারা ফেলে দেওয়ায় খেপে গিয়ে লাফ দিয়ে তারা ট্রলি ডিঙিয়ে এসে প্রবল বিক্রমে আক্রমণ করল গুণ্ডাদের। হাত লাগাল আগের যাত্রীটিও। এই ফাঁকে বনিকে নিয়ে সরে এসে স্বামীর পাশে হাঁটু গেড়ে বসলেন প্রতিভা। তাঁর পাশে সেই বেঁটে চিনা ভ ভদ্রলোকও।
মৃদুস্বরে ওয়াং বললেন, “দ্যাট ওয়াজ এ ন্যাস্টি নক আউট পানচ। তোমার স্বামী কখনও বকসিং করেছে?
“না। জীবনে নয়।”
ওয়াং পকেট থেকে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট বের করে এনে তা থেকে কয়েকটা লম্বা ছুঁচ তুলে নিলেন, বললেন, “আকুপাংচার, খুব কাজ হয়। ওর মুখে চোখে একটু জল দাও।”
বনির বোতলে জল ছিল। প্রতিভা সেই জল ঢেলে হাতের কোষে নিয়ে মুখে-চোখে ছিটিয়ে দিলেন বাবুরামের। আর দক্ষ হাতে বাবুরামের ঘাড়ে এবং আশপাশে উঁচগুলো বিধিয়ে দিলেন ওয়াং।
তিন চিনা কী কায়দা কবল কে জানে, কয়েক মিনিটের মধ্যেই চার-চারটে গুণ্ডার দুজন ধরাশায়ী হয়ে প্রাণ হারাল। দু’জন পালাল।