বাবুরাম স্তম্ভিত হয়ে বললেন, “সর্বনাশ!”
“এব্যাপারে একসময়ে আমিও কিছুদূর গবেষণা করেছি। তাই আমি ব্যাপারটা এত চট করে ধরে ফেলতে পারলাম। তবে মিস্টার গাঙ্গুলি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস বনির মধ্যে এমন কিছু প্রতিক্রিয়া ওরা ওদের রিমোট সেনসরে ধরতে পেরেছে যাতে ওরাও উদ্বিগ্ন। ওরা হয়তো বনিকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করবে। আপনার এখন ওকে। নিয়ে পালিয়ে যাওয়াই উচিত।”
“আমরা পালাতেই চাইছি ডক্টর ওয়াং।”
“সেটা সহজ হবে না। আপনার বাড়িতে আজ তিনজন অতিকায় গুণ্ডাকে ঘায়েল করে মাইককে মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করতে হয়েছে।”
“সর্বনাশ!”
“তাই বলছি, ওরা আপনার পালানোর পথ বন্ধ করার সবরকম চেষ্টা করবে।”
উদ্বেগে আতঙ্কে অস্থির হয়ে বাবুরাম বললেন, “তা হলে কী করব ওয়াং?”
তবু বিপদের ঝুঁকি নিয়েও আপনাকে পালাতেই হবে। নইলে ওরা বনিকে নিয়ে গিয়ে ল্যাবরেটরিতে ওর মাথা চিরে দেখবে কেন ওদের প্ল্যানমতো কাজ হয়নি। ওরা হয়তো আরও অনেক শিশুকেই এরকম গবেষণার বস্তু করেছে। জানি না সেসব শিশুর ভাগ্যে কী ঘটছে। ওরা বর্বর! ওরা মানুষের চরম শত্রু!”
বাবুরাম স্ত্রীর দিকে তাকালেন। প্রতিভা মৃদুস্বরে বললেন, “ভয় পেও না। ঠাকুরের ওপর ভরসা রাখো। আমরা ঠিক পালাতে পারব। বিপদে মাথা ঠিক রাখতে হয়।”
বাবুরাম স্ত্রীর কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তায় একটু শান্ত হলেন।
ওয়াং বললেন, “শুনেছি আপনি ভবঘুরের ছদ্মবেশে পালাতে চান। ভাল পরিকল্পনা। তবে এয়ারপোর্টে তো আর ছদ্মবেশ চলবে না। পাশপোর্ট দেখানোর সময় ছদ্মবেশ খুলতেই হবে। তখন বিপদ। বাবুরাম গাঙ্গুলি, বিজ্ঞানের স্বার্থে আমি আপনাকে সাহায্য করব।”
“করবেন! বাঁচলাম।”
“এখন আমি যাচ্ছি। যথাসময়ে আমার দেখা পাবেন।”
“শুনুন ওয়াং। ডাক্তার লিভিংস্টোনের ক্লিনিক সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?”
“ক্লিনিকটা পোর্টল্যান্ডে?”
ওয়াং-এর খুদে-খুদে চোখ যতদূর সম্ভব বিস্ফারিত হল, “পোর্টল্যান্ডের ডক্টর লিভিংস্টোন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি চেনেন?”
ওয়াং বড় বড় কয়েকটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “ঠিক আছে। ও কথা পরে হবে আপনি আর দেরি করবেন না।”
বাবুরামের মনে হল, ডক্টর লিভিংস্টোন সম্পর্কে কী-একটা কথা চেপে গেলেন ওয়াং। একটু দ্রুত পদেই যেন ওয়াং বেরিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন। গাড়িটা বেশ দ্রুত বেরিয়ে গেল।
বাবুরাম আর প্রতিভা কিছুই খেতে পারলেন না। তাদের অনেক সাধাসাধি করে বডি হার মানল। তবে বনির খাবার যথেষ্টই সঙ্গে ছিল। তাকে প্রতিভা খাওয়ালেন। বিকেল হয়ে আসতেই বাবুরাম আর প্রতিভা তাঁদের ছদ্মবেশ পরে নিলেন। বনির মাথাতেও একটা পরচুলা পরিয়ে নেওয়া হল আর গায়ে মাখিয়ে দেওয়া হল শরীর ট্যান করার রং। বুড়িটা দু’জোড়া রোদ-চশমাও এনে দিল। এসব জিনিস ওরা কুড়িয়েও পায়, চুরিও করে।
ফ্রেড কোথাও গিয়েছিল। দুপুরেই ফিরে এসেছে। সে বলল, “এয়ারপোর্টে গিয়ে পৌঁছনোর কোনও চিন্তা নেই। আমি একটা ডাম্প ইয়ার্ড থেকে পুরনো ফোর্ড গাড়ি জোগাড় করেছি। সেটা বেশ চলে। তবে পুলিশে ধরলে বিপদ আছে। আমাদের লাইসেন্স নেই।”
বাবুরাম বললেন, “সাবধানে চালালে পুলিশ ধরবে না। ঠিক আছে, আমিই চালাব।”
সন্ধের কিছু আগে ফ্রেড আর মাইককে নিয়ে বাবুরাম সপরিবারে এয়ারপোর্টে রওনা হলেন। মুশকিল হল, তাঁরা নিজেদের নামেই প্লেনে টিকিট বুক করতে বাধ্য হয়েছেন। শত্রুপক্ষ খবর পেলে বিপদ আছে কপালে।
নিউ জার্সি পেরিয়ে গাড়ি ব্রুকলিন ব্রিজে উঠল, তারপর নিউ ইয়র্ক শহরকে পাশে ফেলে চলল সোজা জন ফিটজেরাল্ড কেনেডি এয়ারপোর্টের দিকে। অনেকটা রাস্তা। কিন্তু রাস্তায় আর কিছু ঘটল না। গাড়িটা একটু-আধটু আওয়াজ করলেও শেষ অবধি বিশেষ গণ্ডগোল করল না!
টার্মিনালের সামনে তাঁদের নামিয়ে দিয়ে মাইক আর ফ্রেড গেল গাড়িটা পার্ক করে আসতে। পার্ক করা বেশ ঝামেলার ব্যাপার।
দু’জন ভবঘুরের ছদ্মবেশে টার্মিনালে ঢুকতে যেতেই লোজন বেশ তাকাতে লাগল তাদের দিকে। তবে দেশটা আমেরিকা। এখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা খুব বেশি বলে কেউ কারও ব্যাপারে মাথা ঘামায় না।
টার্মিনালে ঢুকে রেস্টরুম-এ গিয়ে দু’জনেই পর্যায়ক্রমে ছদ্মবেশ ছেড়ে এলেন।
বাবুরাম উদ্বেগের গলায় বললেন, “চারদিকে চোখ রেখো প্রতিভা।”
প্রতিভা ছেলেকে আঁকড়ে ধরে আছেন। শান্ত গলায় বললেন, “কিছু হবে না। শান্ত হও। আমি চোখ রেখেছি।”
বাবুরাম চঞ্চল চোখে চারদিকে চাইতে লাগলেন। অনেক যাত্রীর ভিড়ে কাকে তিনি শত্রুপক্ষের লোক বলে চিহ্নিত করবেন? সামনের লাইনটাও বেশ লম্বা। একজন দীর্ঘকায় তোক এসে বাবুরামের পিছনে দাঁড়াল। শ্বেতাঙ্গ। মখচোখ যেন কেমন পাথরে। বাবুরাম একবার তাকিয়েই ভয়ে ভয়ে চোখ সরিয়ে নিলেন। চোরা চোখে লক্ষ করলেন লোকটা তার কোটের পকেটে হাত ভরে আছে।
লোকটা হঠাৎ খুব চাপাস্বরে বলল, “একটা পিস্তলের নল তোমার শরীরের দিকে তাক করা আছে। তোমার স্ত্রীকে বলো কোনওরকম চেঁচামেচি বা গণ্ডগোল না করে ধীরে-ধীরে টার্মিনালের বাইরে যেতে। তুমিও তাই করবে। বাইরে গাড়ি এসে তোমাদের তুলে নেবে।”
বাবুরাম ঠাণ্ডা হয়ে গেলেন ভয়ে। একেবারে কাঠ।
লোকটা পিঠে বাস্তবিকই একটা কঠিন জিনিসের খোঁচা দিয়ে বলল, “পনেরো সেকেণ্ডের বেশি সময় দেব না। চারদিকে আমাদের লোক আছে মনে রেখো।