ওয়াং আবার প্রাচ্য রীতিতে অভিবাদন করে বলেন, “কথা দিচ্ছি বনির কোনও ক্ষতি আমরা করব না। আমি ভাল লোক।”
মাইক অগত্যা ওয়াং-এর সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে তার ছোট্ট গাড়িটায় উঠল। সতর্কতার জন্য ওয়াং-এর নির্দেশে গাড়িটি নানা ঘুরপথে চালানো হল কিছুক্ষণ। তারপর ওয়াং বললেন, “নাঃ, কেউ আমাদের অনুসরণ করছে না। মাইক, এবার তুমি তোমার ডেরার পথ দেখাও।”
.
মাইককে গাড়িতে চেপে অন্য লোকের সঙ্গে ডেরায় আসতে দেখে ভবঘুরেরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কিন্তু ওয়াং গাড়ি থেকে নেমে সকলকে এমন বিনীতভাবে প্রচুর অভিবাদন করতে লাগলেন। যে, ভবঘুরেরা তাঁর সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসতে পারল না।
বাবুরাম একটু দূর থেকে দৃশ্যটা দেখছিলেন। দেখতে-দেখতে হঠাৎ তাঁর মাথায় একটা খবর চিড়িক দিয়ে গেল। এ-লোকটা ডক্টর ওয়াং না? চিনের বিশ্ববিখ্যাত দেশত্যাগী বৈজ্ঞানিক! বাঁ গালে লাল জড়লটা অবধি আছে। কিন্তু গতকালই তো এন বি সির খবরে বলেছে, ডক্টর ওয়াং লন্ডনে সেফ কাস্টডি থেকে পালিয়ে গেছেন। তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না গত বুধবার থেকে।
বাবুরাম এগিয়ে এসে ওয়াং-এর সামনে দাঁড়ালেন। খানিকক্ষণ কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, “আমার যদি খুব ভুল না হয়ে থাকে তা হলে আপনি ডক্টর ওয়াং।”
ওয়াং আভূমি নত হয়ে অভিবাদন করে বিগলিত কণ্ঠে বললেন, “দেখা যাচ্ছে আমি সত্যিই বিশ্ববিখ্যাত। বাবুরাম গাঙ্গুলি, আপনিও কম বিশ্ববিখ্যাত নন। আমি টিভিতে আপনার ছবি দেখেছি। আপনার স্ত্রী এবং ছেলেকেও সবাই চিনে ফেলেছে।”
“ডক্টর ওয়াং, আপনি তো আমেরিকাতেই এলেন, তবে লন্ডনের সেফ হাউস থেকে পালালেন কেন?”
ওয়াং ব্যথিত গলায় বললেন, “না পালালে ওরা কী করত জানেন? আমাকে ভি আই পি সাজিয়ে এখানে এনে একরকম নজরবন্দী করে নানারকম জেরায় পেটের কথা বের করত। দেশত্যাগীদের কি ঝামেলার অন্ত আছে? তাতে আমার মূল্যবান সময় নষ্ট হত, কাজের কাজ হত না। তাই পালিয়ে বন্ধুদের সাহায্যে ছদ্মবেশে ভূয়া পাসপোর্ট দেখিয়ে চলে এসেছি।”
বাবুরাম মাথা নেড়ে বললেন, “বুঝেছি, আপনি দুঃসাহসী মানুষ। দেশ ছেড়ে পালালেন কেন ডক্টর ওয়াং?”
“প্রতিভাবানদের কোনও দেশ নেই গাঙ্গুলি। পুরো পৃথিবীটাই তাদের কাজের জায়গা। একটা দেশে আটকে থাকলে তাদের চলে না। আমাকে আপনি বিশ্বনাগরিক বলে ভাবতে পারেন।”
বাবুরাম এই দুঃখেও ওয়াং-এর কথায় হাসলেন। বললেন, “আপনার কী একটা আবিষ্কার চুরি গেছে বলে শুনেছি।”
ডক্টর একথায় হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তাঁর চোখ ছলছল করতে লাগল। রুমাল বের করে তিনি চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠে বললেন, “ওকথা মনে করিয়ে দেবেন না বাবুরাম গাঙ্গুলি। সে ছিল আমার বুকের হাড়, চোখের মণির চেয়েও মূল্যবান। ওরকম বায়োমেকানিক রোবট কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি আজও। তার ভিতরে আমি এক অনন্ত শক্তির উৎস সৃষ্টি করেছিলাম। শুধু সেটার একটাই দোষ ছিল, সে নিজে থেকে কিছু করতে পারত না। তবে কাছাকাছি মানুষের ইচ্ছে বা চাহিদা অনুসারে সে অনেক অসম্ভব সম্ভব করতে পারে। তার নাম দিয়েছিলাম চি চেং। আমার ছেলে থাকলে সেও আমার এত প্রিয়পাত্র হত না, যতটা ছিল চি চেং।”
ওয়াং খানিকটা সামলে ওঠার পর বললেন, “গাঙ্গুলি, আপনার ছেলের বিষয়ে আমি শুনেছি। আমি কি তাকে একবার দেখতে পারি?”
“নিশ্চয়ই। আসুন ডক্টর ওয়াং।”
বাবুরাম গুদামের ভিতরে, যেখানে বনিকে কোলে নিয়ে প্রতিভা বসে ছিলেন, সেখানে নিয়ে গেলেন। প্রতিভা প্রথমে ওয়াংকে দেখে অস্বস্তি বোধ করলেও বাবুরামের ইশারায় বনিকে ওয়াং-এর হাতে দিলেন।
সঙ্গে-সঙ্গে বনির চোখ দুখানা প্রথমে নীল তারপর সবুজ হয়ে গেল।
ওয়াং কিছুক্ষণ চোখ দুটোর দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “এই রংগুলোর অর্থ আছে। ও আমাকে দেখে খুশি হয়েছে।”
বাবুরাম মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “বনির অসুখটা কী ডক্টর ওয়াং?”
ওয়াং বনিকে শুইয়ে দিয়ে তার সঙ্গীকে ডেকে একটা হুকুম দিলেন। তার সঙ্গী দৌড়ে গিয়ে একটা কালো বাক্স নিয়ে এল। ওয়াং সেই বাক্সটার ডালা খুলতে দেখা গেল ভিতরে নানা জটিল ও সূক্ষ্ম সব যন্ত্রপাতি রয়েছে। এত জটিল যে, বাবুরাম অবধি যন্ত্রটার প্রকৃতি বুঝতে পারলেন না।
ওয়াং বললেন, “এটা অত্যাধুনিক একটা স্ক্যানার। কোনও ভয় নেই, এই যন্ত্র আপনার ছেলের কোনও ক্ষতি করবে না।”
আধ ঘণ্টা ধরে ওয়াং বনির শরীরের সর্বত্র একটা স্টেথসকোপ জাতীয় জিনিস লাগিয়ে পরীক্ষা করলেন। তার ভূ কুঞ্চিত, মুখে চিন্তার বলিরেখা। তারপর যন্ত্র গুটিয়ে নিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, “ব্যর্থতা! আবার একটা ব্যর্থতা! লোকগুলো অপদার্থ।”
বাবুরাম উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ডক্টর ওয়াং?”
“আপনার ছেলের এমব্রায়োতে একটি বায়োনিক মাইক্রোচিপ কেউ সেট করে দিয়েছিল। জিনিসটা এত ছোট যে আপনার সে সম্পর্কে ধারণাই হবে না। চিপটা ঠিকমতো সেট হয়ে গেলে আপনার ছেলে হয়ে উঠত আধা-যন্ত্র, আধা-মানুষ। কিন্তু গবেষণাটি এখন পরীক্ষামূলক স্তরে আছে বলেই আমার ধারণা, যারা এটা করছে তারা খবর রাখছে, কোন মা কখন সন্তানসম্ভবা হয়েছেন। তাদের অজান্তেই গর্ভস্থ সন্তানের মধ্যে ইনজেকশন দিয়ে ওই মাইক্রোচিপ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই মাইক্রোচিপের ধর্মই হল তা ভূণের শরীরে ঢুকেই শিরা-উপশিরা দিয়ে মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছয়। সেই ভুণ যখন। সন্তান হয়ে জন্মাবে তখন হবে অত্যধিক মেধাবী, অত্যধিক কর্মপটু, কিন্তু তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখবে অন্য লোক। এইসব সন্তান মাঝে-মাঝে রিমোট কন্ট্রোলে প্রত্যাদেশ পাবে। এবং সেই আদেশ এরা অক্ষরে-অক্ষরে মানতে বাধ্য। এদের দিয়ে যা খুশি করানো যাবে। মিস্টার বাবুরাম গাঙ্গুলি, আমি দুঃখিত, আপনিও এইসব শয়তনের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। তবে বনির ক্ষেত্রে মাইক্রোচিপটা কোনও কারণে ঠিকমতো কাজ করছে না। কোনও একটা বায়ো মেকানিকাল গোলমাল ওর মস্তিষ্ক আর শরীরের মধ্যে একটা পরদা পড়ে গেছে। ওর মাথা ক্রিয়াশীল, কিন্তু শরীর নয়।”