দৈত্যাকার লোকটা একটা রবার হোসের টুকরো জ্যাকেটের তলা থেকে বের করে সজোরে মাইকের গালে বসিয়ে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে মাইক যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো শিউরে উঠে অজ্ঞান হয়ে গেল।
ওয়াং অত্যন্ত নাভাস হয়ে বললেন, “আমি…আমি কোনও নিষ্ঠুর দৃশ্য সহ্য করতে পারি না। আমার শরীর অস্থির লাগছে…”
সেই লম্বা নোকটা পিছন থেকে এসে ওয়াং-এর কাঁধে হাত রেখে বলল, “আপনি বসুন ডক্টর ওয়াং।”
একরকম চেপেই সে ওয়াংকে সোফায় বসিয়ে দিল। ওয়াং টের
পেলেন, বসানোর সময় তাঁর হিপ পকেট থেকে লোকটা ডলারের বান্ডিলটা অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে তুলে নিল।
ওয়াং বসে রুমালে কপাল মুছলেন। তারপর রুমালটা বুক পকেটে রাখলেন। তাঁর কুশলী হাতে পকেট থেকে একটা ডটপেন উঠে এল।
ওয়াং কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “মিস্টার জন স্মিথ, আমি একটু জল খেতে চাই।”
স্মিথ তাঁর সামনে এসে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে বলল, “নিশ্চয়ই ডক্টর ওয়াং। এই টম, একটু জল আনো।”
টম জল আনতে গেল। স্মিথ ওয়াং-এর দিকে চেয়ে একটু হাসল। তারপর কী হল তা স্মিথ কখনও বলতে পারবে না। পিং করে একটা মৃদু শব্দ সে শুনল। তারপর আর তার কিছু মনে নেই।
তিন নম্বর লোকটা লিভিং রুমে টিভি চালিয়ে কোনও প্রোগ্রাম দেখছিল। ওয়াং নিঃশব্দে লিভিং রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। লোকটা তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে অবাক হয়ে কী যেন বলতে যাচ্ছিল। বলাটা আর হয়ে উঠল না তার। একটা ছোট্ট ছুঁচ গিয়ে সোজা তার মুখগহ্বরে ঢুকে গেল।
টম জল নিয়ে রান্নাঘর থেকে শিস দিতে দিতে ফিরে আসছিল। আচমকাই ঘাড়ে একটা সূক্ষ্ম ব্যথা টের পেল সে। জলের গেলাসটা পড়ে গেল হাত থেকে। তারপর সেও পড়ল।
ওয়াং আর দেরি করলেন না। বাড়িটা ঘুরে দেখে নিলেন। বুঝলেন, বনি ও বাড়িতে তো নেই-ই, সম্ভবত কারও ভয়ে ওরা পালিয়েছে।
ওয়াং আগে গুন্ডাদের পকেট থেকে তাঁর ডলারগুলো বের করে নিলেন। তারপর ঠাণ্ডা জল নিয়ে এসে মাইকের পরিচর্যা করতে বসলেন। তার বুকে আর কপালে অত্যন্ত কুশলী হাতে কিছুক্ষণ মাসাজ করার পর মাইক ধীরে ধীরে চোখ খুলল। চোখে আতঙ্ক।
ওয়াং বললেন, “কোনও ভয় নেই।”
“ওরা কোথায়?”
ওয়াং হেসে বললেন, “ঘুমোচ্ছে। ওই দ্যাখো কী নিশ্চিন্ত ঘুম!”
মাইক উঠে বসল। যেন গ্রহান্তরের জীব দেখছে এমনভাবে ওয়াং-এর দিকে হাঁ করে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “তুমি এই তিনটে দানবের মহড়া একা নিয়েছ! তাজ্জব। তোমাকে তো এরা মশামাছির মত টিপে মেরে ফেলতে পারে।”
ওয়াং খুব অমায়িকভাবে বলল, “দুর্বলের ভগবান আছেন। আর আছে ঈশ্বরদত্ত বুদ্ধি এবং কৌশল। এখন ওঠো। এখানে থাকা আর আমাদের পক্ষে নিরাপদ নয়।”
“দাঁড়াও। আমার কিছু কাজ আছে।”
এই বলে মাইক টপ করে উঠে সোজা দোতলায় শোওয়ার ঘরে গিয়ে ঢুকল। কাবার্ড থেকে নির্দিষ্ট অ্যাটাচি কেস এবং বাক্স থেকে টাকার একটা বান্ডিল বের করে নিল। তারপর নেমে এসে বলল, “আমি যাচ্ছি। তোমাকে ধন্যবাদ।”
ওয়াং নিচু হয়ে অভিবাদন করে বললেন, “মাননীয় মহাশয়, তুমি অবশ্যই যেতে পারে। কিন্তু তোমাকে নিশ্চিন্ত করার জন্যই জানাতে চাই যে, আমি খুব ভাল লোক। আমি এদের মতো বদমাশ নই। আর তোমাকেও গৃহস্বামীর অনুপস্থিতিতে কিছু চুরি করে পালাতে দিতে পারি না।”
মাইক ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “আমি চুরি করছি না।”
“তোমার হাতে একটা অ্যাটাচি কেস দেখতে পাচ্ছি। ওটা তোমার নয়। কারণ তোমার পোশাকটোশাক বা চেহারার সঙ্গে ওই দামি জিনিসটা মানাচ্ছে না।”
মাইক নিরুপায় হয়ে বলল, “এটা এ বাড়ির মালিকের জন্যই নিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বাস করো।”
“বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। প্রমাণ কী?” মাইক সন্দিহান চোখে লোকটাকে নিরিখ করে বলল, “তোমাকে বলা যাবে না।”
“তা হলে তোমাকেও ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়।”
মাইক বিপন্ন হয়ে চোখ মিটমিট করে বলল, “ওরা খুব বিপদে পড়েছে। কিছু দুষ্ট লোক ওদের খুন করে ওদের বাচ্চাটাকে চুরি করতে চাইছে।”
ওয়াং মাইকের কাঁধে হাত রেখে বলল, “পাঁচশো ডলার পেতে তোমার কেমন লাগবে?”
“খুব ভাল। কিন্তু আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।”
“বিশ্বাসঘাতকতা করার দরকার হলে আমি তোমার মুখ থেকেই জোর করে কথা বের করতে পারতুম। মনে রেখো ডক্টর ওয়াং একজন জিনিয়াস। আমার কাছে এমন জিনিস আছে যা দিয়ে তোমাকে অবশ বিহ্বল করে কথা বের করতে পারি। কিন্তু আমি সেরকম লোক নই।”
“তোমাকে বিশ্বাস করি কী করে?”
“করলে ঠকবে না। বনি নামক বাচ্চাটির যে অলৌকিক ক্ষমতা আছে তা আমি জানি। আমি তাকে একবার দেখব বলে পৃথিবীর আর এক প্রান্ত থেকে অনেক কষ্ট করে ছুটে এসেছি। যতদূর অনুমান করছি এইসব বদমাশদের ভয়ে বনিকে নিয়ে তার মা বাবা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে এবং তুমি তাদের সাহায্য করছ। খুব ভাল কথা। আমার মনে হয় সেটাই উচিত। তবে একটুক্ষণের জন্য হলেও বনিকে আমি দেখতে চাই।”
মাইক দ্বিধায় পড়লেও বুঝল, এ-লোকটাকে এড়ানো সহজ হবে। লোকটা ভয়ঙ্কর ধূর্ত। তবে মাইককে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে বলে মাইক খানিকটা কৃতজ্ঞও বোধ করছিল। দোনোমোনো করে সে বলল, “দ্যাখো, তোমাকে আমি নিয়ে যেতে রাজি। কিন্তু আমাদের ডেরায় ঢুকে কোনওরকম বেগড়বাঁই করলে কিন্তু আমরা সবাই মিলে তোমাকে ঢিট করে দেব।”