বাবরাম খুবই চিন্তিত হলেন।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই একখানা গাড়ি এসে গেল। প্রতিভা আর বাবরাম তাঁদের বাড়িতে ফিরে এলেন।
তাঁরা ফিরে আসবার পর প্রতিবেশী মাগারেট নামে একটি মেয়ে এসে খুব অবাক গলায় বলল, “তোমরা কোথায় ছিলে? পুলিশ-স্টেশন থেকে নোক এসে তোমাদের সম্পর্কে খোঁজখবর করে গেছে। তোমরা নাকি গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছ? গাড়িটা একদম স্ম্যাশড হয়ে গেছে। অথচ তোমাদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।”
এসব প্রশ্নের সদুত্তর বাবুরামের জানা নেই। তিনি চুপ করে রইলেন।
তারপর ধীরে-ধীরে ঘটনাটার কথা কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের স্মৃতিতে ফিকে হয়ে আসতে লাগল। আমেরিকায় কাজের লোকদের বিশ্রাম বলে কিছু নেই। প্রতিভাও চাকরি করেন। হাড়ভাঙা খাটুনি, দোকানবাজার করা, ঘরদোর গোছানো, রান্নাবান্না, কাপড়কাঁচা, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ইত্যাদিতে মানুষের আর অলস চিন্তার সময় থাকে না। সুতরাং ঘটনাটা নিয়ে তাঁরা বেশি মাথা ঘামানোর সময় পেলেন না।
এই ঘটনার ঠিক এগারো মাস বাদে তাঁদের প্রথম সন্তান জন্মাল। একটি ছেলে।
কিন্তু ছেলেটি জন্মানোর পরই দেখা গেল, তার হাত-পা অসাড় এবং স্থির। কান্নাকাটি তো দূরের কথা, কোনও শব্দই করল না
বাচ্চাটা জন্মের পর। ডাক্তাররা প্রথম তাকে মৃত বলে মনে করেছিলেন। জীবনের লক্ষণ দেখে তাকে রেখে দেওয়া হল একটি অক্সিজেন টেন্টের ভিতরে।
বাবুরামকে ডাক্তার গম্ভীর মুখে বললেন, “তোমার ছেলেটির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। যদি বাঁচে তবে বাঁচবে উদ্ভিদের মতন। নড়াচড়া করতে পারবে না, কথা বলতে পারবে না। চিরকাল ওকে। তোমাদের খাইয়ে দিতে হবে, টয়লেট করাতে হবে।”
বাবুরামের চোখে জল এল। এতদিন পরে যদিও-বা সন্তান হল তাও জড়পদার্থ বিশেষ।
ডাক্তার ক্ষীণ ভরসা দিয়ে বললেন, “নিউ ইয়র্কে ডাক্তার ক্রিলের কাছে একবার নিয়ে যেও। উনি বিশ্ববিখ্যাত নিউরোসার্জেন। যদি কিছু পারেন উনিই পারবেন। তবে আপাতত আমরা মাসখানেক বাচ্চাটিকে অবজারভেশনে রাখব।
নিউ ইয়র্কের মস্ত এক হাসপাতালের নিউরোলজির সর্বেসর্বা ডাক্তার ক্রিল। জেমস ক্রিলের খ্যাতি সত্যিই বিশ্বজোড়া।
ডাক্তার ক্রিল বাবুরামের বাচ্চাটাকে দেখলেন। নানারকম পরীক্ষা করে বললেন, “এর জড়তার কারণ আমরা ঠিক ধরতে পারছি না। মস্তিষ্কে কোন একটা অবস্ট্রাকশন আছে। আরও কিছু ইনভেস্টিগেশন দরকার।”
ডাক্তার জেমস ক্রিলের হাসপাতালে বনি অর্থাৎ বাবুরামের ছেলেকে ভর্তি করে দেওয়া হল।
অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হল। অবশেষে ক্রিল বললেন, “অপারেশন ছাড়া কোনও উপায় দেখছি না।”
অপারেশনের নামে ভয় পেলেন বাবুরাম আর প্রতিভা। তাঁদের অনেক আকাঙক্ষার ধন ওই বনি। ওইটুকু তো ছেলে, সে কি মাথার অস্ত্রোপচার সহ্য করতে পারবে?”
ক্রিলকে সে কথা বলতে তিনি চিন্তিতভাবে বললেন, “আপনার ছেলেকে আমি সবরকমভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি। তার হার্ট, লাংস চমৎকার। অপারেশনের ধকল সে সহ্য করতে পারবে বলেই মনে হয়।”
বাবুরাম আর প্রতিভা চোখের জল ফেলতে-ফেলতে হাসপাতালের কাছেই যে-হোটেলে তাঁরা এসে উঠেছেন সেখানে ফিরে এলেন এবং ঘরের দরজা বন্ধ করে দু’জনেই মন-খারাপ করে বসে রইলেন।
ডাক্তার ক্রিল থাকেন সাউথ অফ ম্যানহাটানে। তাঁর বাড়িটি বিশাল।
অপারেশনের প্রস্তুতি শেষ করে ফেলেছেন ডাক্তার ক্রিল। আগামী কাল তিনি এই অদ্ভুত শিশুটির মস্তিষ্ক খুলে দেখবেন সেখানে গণ্ডগোলটা কিসের।
দোতলার বিশাল শয়নকক্ষে ডাক্তার জেমস ক্রিল একাই থাকেন। অন্যান্য ঘরে তাঁর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা। রাত দুটো নাগাদ এক, প্রবল অস্বস্তিতে ক্রিলের ঘুম ভাঙল। তিনি শুনতে পেলেন, খাটের পাশে তাঁর টেলিফোনটা বাজছে।
“হ্যালো।” একটা গম্ভীর ধাতব গলা বলল, “সুপ্রভাত, ডাক্তার ক্রিল। কাল সকালে একটি বাচ্চার ব্রেন অপারেশন করতে যাচ্ছ তুমি?”
“সেকথা ঠিক।”
“কোরো না, ও যেমন আছে তেমনই থাকতে দাও, প্লিজ।”
“তুমি কে?”
“আমাকে চিনতে পারবে না।”
ফোন কেটে গেল। টেলিফোনে হুমকি বা ফাঁকা আওয়াজ ব্যাপারটা, নতুন বা অভিনব কিছু নয়। দুনিয়ায় নিষ্কমা, পাগল, বদমাস কত আছে। ক্রিল ব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ভোর চারটে নাগাদ ক্রিল তাঁর বুকে একটা চাপ অনুভব করলেন। তাঁর খুব ঘামও হচ্ছিল। তাঁর বয়স চল্লিশের কোঠায়, তিনি নিয়মিত ব্যায়াম করেন এবং স্বাস্থ্যও ভাল। এরকম হওয়ার কথা নয়। তিনি তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন। বাড়ির লোককে ডেকে তুলবেন না হাসপাতালে ফোন করবেন তা স্থির করতে একটু সময় গেল।
হঠাৎ আবার টেলিফোন বেজে উঠল।
“হ্যালো।”
এবারে একজন মহিলার কণ্ঠস্বর। বেশ মোলায়েম গলা, “সুপ্রভাত, ডাক্তার ক্রিল। আশা করি তুমি বনির ওপর অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত বদল করেছ!”
ডাক্তার ক্রিল,বললেন, “না তো! কিন্তু তোমরা কারা? কেন এই অপারেশন বন্ধ করতে চাও?”
“সেটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। আমরা চাই বাচ্চাটা যেমন আছে তেমনই থাকতে দাও।”
“তাতে বাচ্চাটার ক্ষতিই হবে।”
“অপারেশন করলে তার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তুমি মস্ত ডাক্তার বটে, কিন্তু তুমিও ভগবান নও। গত এক বছরে তোমার তিনজন রুগি অপারেশনের পর মারা গেছে। জার্সি সিটির, পি ডি আথারটন, কুইনসের মিসেস জে চেস্টারফিল্ড, বেকার্সফিল্ডের জন কোহেন।”