দৈত্যাকার লোকটা বিভীষণ মুখে মাইকের দিকে তাকিয়ে তার দুঃসাহস দেখছিল।
মাইক বলল, “আমি খবর এনেছি। বনির খবর।”
লোকটা দরজা খুলে বিনা বাক্যব্যয়ে মাইকের কোটের কলার ধরে প্রায় ইঁদুরছানার মতো তুলে ঘরে টেনে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। “বনির খবর তুমি জানো? বলল কী খবর, বনি কোথায় আছে?”
লোকটা তার কলার ছাড়েনি। এরকম শক্তিশালী লোকের পাল্লায় এর আগে কখনও পড়েনি মাইক। সে হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল, “বলছি বলছি। কিন্তু আমি কী পাব?”
“পাবে! বলেই লোকটা তাকে শূন্যে তুলে মেঝের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বুকের ওপর একটা ভারী পা তুলে দাঁড়াল, নোংরা নেশাখোর, চোর, বাউণ্ডুলে, তোমাকে যে খুন না করে ছেড়ে দেব সেটাই বড় পাওনা বলে জেনো। এখন ঝেড়ে কাসো তো বাছাধন, বনি কোথায়?”
মাইক বুঝল, এই দৈত্যের হাত থেকে রেহাই পাওয়া শক্ত হবে। শুধু এ লোকটাই নয়, আড়চোখে সে দেখতে পেল, আরও দুটো লোক লিভিংরুমের দরজার কাছে বুকে আড়াআড়ি হাত রেখে দাঁড়িয়ে। তাদের চেহারা ভাড়াটে খুনির মতোই। এরকম বিপদে পড়তে হবে জানলে সে বোকার মতো কিছুতেই ডোরবেল বাজাত ভারী পায়ের চাপে বুকের পাঁজরা মড়মড় করছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে মাইকের। সে চি-চি করে বলতে চেষ্টা করল, “বনিকে দিয়ে তোমরা কী করবে? সে দেবশিশু।”
“সে খবরে তোর কী দরকার? সোজা কথায় জবাব দে, বনি কোথায়? তার মা বাবাকেও আমরা চাই। বাবুরাম আর তার বউ দুই শয়তান আমাদের আদেশ অমান্য করেছে, ওদের বেঁচে থাকবার অধিকার নেই।”
বুটের নিষ্পেষণে মাইকের বুকে এত যন্ত্রণা হচ্ছিল যে, সে আর বেশিক্ষণ চেতনা ধরে রাখতে পারবে না।
বাবুরামের বাড়ির অভ্যন্তরে যখন এই ঘটনা ঘটছে তখন বাড়ির বাইরে আরও একটি ঘটনা দানা বাঁধছে। বাড়ির অনতিদূরেই অনেকক্ষণ ধরে একটি ছোট গাড়ি পার্ক করা আছে। গাড়ির কাঁচ স্বচ্ছ বলে ভিতরটা দেখা যায় না। বাতানুকুল গাড়ির অভ্যন্তরে দু’জন মানুষ পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে অনেকক্ষণ। তারা দেখেছে, একজন ভবঘুরে এল এবং তাকে অত্যন্ত কর্কশভাবে টেনে নেওয়া হল ভিতরে।
দু’জনের একজন বেঁটেখাটো ডক্টর ওয়াং। তিনি হঠাৎ মৃদুস্বরে বললেন, “যতদূর মনে হচ্ছে, বাড়ির ভিতরে আসল লোকেরা নেই। কিছু অবাঞ্ছিত লোক ঢুকে পড়েছে। আর ওই ভবঘুরেটা, নাঃ, ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে লি চিং।”
“আমি আপনার সঙ্গে যাব কি?”
ওয়াং মাথা নেড়ে বললেন, “কক্ষনো নয়। আমেরিকায় আমার লোকবল সামান্য। তোমার কিছু হলে আমি দুর্বল হয়ে পড়ব।”
“কিন্তু আপনার যদি কিছু হয় ডক্টর ওয়াং?”
ওয়াং মাথা নাড়লেন, “বর্বররা কখনওই আমার ক্ষতি করতে পারে না। জীবনে আমি অজস্র বিপদে পড়েছি। তুমি সতর্ক সজাগ হয়ে বাড়িটার ওপর নজর রাখো। আমাকে ভিতরে ঢুকতে হবে।”
ওয়াং গাড়ি থেকে নেমে সোজা গিয়ে ডোরবেল টিপলেন।
দু সেকেণ্ডের মধ্যে দরজা খুলে গেল। একজন ছিপছিপে লম্বা বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের মতো চেহারার লোক দরজার সামনে দাঁড়াতেই ওয়াং মাথা নত করে অভিবাদন জানিয়ে একগাল হেসে বললেন, “সেই ওয়াণ্ডার চাইল্ড বনিকে দেখতে এসেছি আমি।”
“আপনি কে?”
“ডক্টর ওয়াং–একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিক। পদার্থবিদ এবং ইলেকট্রনিক্স বিশেষজ্ঞ।”
“বনি এখন নেই। ওরা বেড়াতে গেছে।”
ওয়াং ফের অভিবাদন করে বললেন, “আমি জানি কৌতূহলী মানুষেরা আপনাদের বিরক্ত করে। দয়া করে বিরক্ত হবেন না। আমি যথেষ্ট ধনী ব্যক্তি। শিশুটিকে পাঁচ মিনিট পরীক্ষা করতে দিলে আমি তার জন্য পাঁচশো ডলার দিতে প্রস্তুত।”
লোকটা হাত বাড়িয়ে বলল, “আগে পাঁচশো ডলার দাও, তারপর দেখব কী করা যায়।”
“অবশ্য, অবশ্য।” বলে ওয়াং হিপ-পকেট থেকে যে নোটের তাড়াটা বের করলেন তাতে একশো ডলারের নোটে অন্তত হাজার-দশেক ডলার আছে। অত্যন্ত অমায়িকভাবে ওয়াং পাঁচখানা নোট লোকটার হাতে দিয়ে বললেন, “আমি ধন্য।”
লম্বা লোকটা দরজাটা আর-একটু ফাঁক করে ধরে বলল, “চলে আসুন।”
ওয়াং ঘরে ঢুকতেই একটা হোঁচটের মতো খেলেন। তাঁর মনে হল, ঠিক হোঁচট এটা নয়, ওই লোকটাই তার জুতোর ডগায় একটু ঠোক্কর মারল।
লোকটা দরজাটা বন্ধ করে দিল।
সামনের দৃশ্যটা দেখে ওয়াং-এর যেন মুখ শুকিয়ে গেল। হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “এ কী? এসব কী হচ্ছে এখানে! অ্যাঁ!”
দৈত্য-চেহারার লোকটা মাইকের বুক থেকে পা নামিয়ে ওয়াং-এর দিকে ফিরে বলল, “এ লোকটা চোর।”
ওয়াং পকেট থেকে রুমাল বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে কপালের ঘাম মুছতে-মুছতে বললেন, “চোর! চোর খুবই খারাপ জিনিস।”
প্রকাণ্ড লোকটা হাত বাড়িয়ে ওয়াং-এর সঙ্গে করমর্দন করে বলল, “এই বিশ্রী ব্যাপারটা তোমাকে দেখতে হল বলে দুঃখিত ডক্টর ওয়াং। আমার নাম জন স্মিথ।”
ওয়াং খুব অমায়িক গলায় বললেন, “আপনার পরিচয় পেয়ে খুব খুশি হলাম মিস্টার স্মিথ। কিন্তু আমি সেই অদ্ভুত শিশুটিকে দেখতে চাই।”
“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই ডক্টর ওয়াং। আগে এই চোরটার একটা ব্যবস্থা করে নিই।”
ওয়াং মেঝেয় আধমরা হয়ে পড়ে থাকা মাইকের দিকে তাকালেন। লোকটা ভবঘুরে। ওয়াং খুব বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “এ লোকটার অপরাধ কী? ও কী করেছে?”
মাইক নিজের বুক চেপে ধরে যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে বলল, “আমাকে ছেড়ে দাও, বনি কোথায় আছে আমি জানি না, টাকার লোভে মিথ্যে কথা বলেছিলুম।”