পুরুষটি একটু হাসল, “ওটা কোনও ব্যাপার নয়।”
প্রতিভা বলল, “টিকিট বা পাশপোর্ট বের করে আনা বিপজ্জনক হবে। ওরা খুব খারাপ লোক খুনখারাপিও করতে পারে।”
বুড়িটা বলল, “ভেবো না বাছা। আমরা অনেক সুলুকসন্ধান। জানি। একটা বাড়িতে ঢুকে কী করে জিনিস বের করতে হয় তা আমাদের বাচ্চারাও জানে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।”
প্রতিভা বললেন, “আমাদের এই গাড়িটাও লুকিয়ে ফেলা দরকার। এটা ওরা বোধ হয় চিনে ফেলেছে!”
বাবুরাম অবাক হয়ে বললেন, “কী করে?”
“যে গ্যাস স্টেশনে আমরা তেল ভরেছি সেখানেও ওরা খোঁজ নেবে এবং উন্ডেড লোক দুটোও বলে দিতে পারে। সাবধানের মার নেই।”
বাবুরাম গলা চুলকে বললেন, “তা বটে। বিপদে তোমার বুদ্ধি খোলে। কিন্তু আমার বুদ্ধি ঘুলিয়ে যাচ্ছে।”
“ঘাবড়াবার কিছু নেই। এরা বনিকে দেবশিশু বলে ধরে নিয়েছে। এরা ওকে বাঁচাবেই।”
“কিন্তু দেশে ফিরতে হলে আমাদের টাকা চাই। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার কী হবে? আজ যে ব্যাঙ্ক বন্ধ। সেই সোমবার খুলবে।”
“ওটা নিয়ে ভেবো না। দেশে যেতে আমাদের সামান্য টাকা লাগবে। শুধু এয়ারপোর্টে যাওয়ার যেটুকু খরচ। আমার ব্যাগে পাঁচশো ডলার আছে। যথেষ্ট। দেশে গেলে টাকার তো অভাব হবে না।”
বাবুরাম তবু বললেন, “লাগেজ? আমাদের সঙ্গে তো জিনিসপত্র কিছুই নেই।”
“লাগবে না। তুমি বনিকে আমার কাছে রেখে কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে প্যান অ্যাম-এর কাছে খোঁজ করে দ্যাখো আজকের ফ্লাইটে দুটো সিট পাওয়া যায় কি না। যদি ভারতবর্ষের টিকিট না পাওয়া যায় তা হলেও ক্ষতি নেই। আমরা ইউরোপ পৌঁছতে পারলেও হবে। সেখানে দু’দিন অপেক্ষা করে দেশে ফিরবার ব্যবস্থা করব।”
বাবুরাম এই প্রস্তাব মেনে নিলেন।
পুরুষটি এগিয়ে এসে বলল, “তোমরা কী নিয়ে আলোচনা করছ। তা জানতে পারি?”
প্রতিভা লোকটাকে তাঁদের সমস্যার কথা বুঝিয়ে বললেন।
লোকটা মন দিয়ে শুনে বলল, “নো প্রবলেম। তোমাদের কিছু জামাকাপড় আমি একটা স্যুটকেসে ভরে নিয়ে আসব। আলমারির চাবি দাও, ডলারও বের করে আনব। আমি তোমাদের গাড়িটা নিয়েই যাচ্ছি। গাড়িটা আমি ফিরিয়ে আনব না। আর যদি কাউকে টেলিফোন করতে চাও তো ওই যে ল্যাম্পপোস্টটা দেখছ ওর পরেই বাঁ ধারে পাবলিক টেলিফোন পাবে।”
লোকটা গাড়ি নিয়ে চলে গেল। বাবুরাম গেলেন টেলিফোন করতে। দুরুদুরু বুকে প্রতিভা ভবঘুরেদের সঙ্গে তাদের নোংরা ঘরে গিয়ে বনিকে নিয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
প্রায় এক ঘন্টা বাদে বাবুরাম ফিরে এসে বললেন, “প্যান অ্যাম-এর দিল্লি ফ্লাইটে দুটো সিট পাওয়া গেছে।”
প্রতিভা চিন্তিত মুখে বললেন, “এখন ভালয়-ভালয় প্লেনে উঠতে পারলে হয়”।
বুড়িটা এসে তাদের সামনে দুটো প্লাস্টিকের প্লেটে কিছু খাবার রেখে বলল, “শোনো বাছারা, যদি দুষ্ট লোকের চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে হয় তা হলে ওরকম বাবু বিবির মতো পোশাক পরলে চলবে। এই আমাদের মতো উলোঝুলো পোশাক আর উইগ চাই।”
ওরকম নোংরা পোশাক পরার প্রস্তাবে বাবুরাম নাক সিটকোলেন। কিন্তু প্রতিভা বললেন, “আমরা ওই পোশাকই পরব বুড়িমা, আমাদের জোগাড় করে দাও।”
বুড়ি নির্বিকার মুখে বলল, “আমাদের দুটো বুড়োবুড়ি সেদিন মারা গেছে। ওই মেপল গাছটার তলায় তাদের পুঁতে দিয়েছি। তাদের একজোড়া পোশক আমার কাছে আছে। অন্য কেউ হলে পোশাক দুটোর জন্য অন্তত পাঁচ ডলার নিতুম। তোমাদের কাছ থেকে নেব না। তোমরা বনির মা বাবা কি না।”
বুড়ি পোশাক দুটো এনে দিল। একজোড়া পরচুলাও। পোশাক বলতে অত্যন্ত ময়লা একটা ঘন নীল রঙের কোট আর তাপ্লিমারা ট্রাউজার্স, একটা বেঢপ কামিজ আর জিনসের প্যান্ট।
বাবুরাম পোশাক দেখে বিবর্ণ হলেন ঘেন্নায়। প্রতিভা চাপাস্বরে বললেন, “বাঁচবার জন্য সব কিছু করতে হয়। ঘেন্না পেলে চলবে না।”
.
বাবুরামের বাড়ি থেকে অন্তত আধ মাইল দূরে হোন্ডা গাড়িটা একটা লেন-এর মধ্যে নিয়ে গেল মাইক-অর্থাৎ ভবঘুরে পুরুষটি। তারপর একটা আজঙ্গল জায়গায় গাড়িটা ঢুকিয়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে রওনা হল। সমস্ত অঞ্চলটা মাইকের নখদর্পণে। কাজেই বড় রাস্তা ছেড়ে নানা ছোটখাটো বাজে-রাস্তা পেরিয়ে সে বাবুরামের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে চারদিকটা ভাল করে লক্ষ করল। এমনিতেই শহর দিনের বেলায় জনশূন্য থাকে। তবে আজ উইক এন্ড শুরু হয়েছে বলে অনেকে ঘরের কাজ করতে বাড়িতে রয়েছে।
সন্দেহজনক কিছু না দেখে মাইক রাস্তাটা পেরিয়ে বাবুরামের দরজায় উপস্থিত হল। ভবঘুরেরা ভিক্ষে-টিক্ষে চেয়ে বেড়ায়, সুতরাং তাকে চট করে কেউ সন্দেহ করবে না। মাইক চারপাশটা দেখে নিয়ে দরজাটা পরীক্ষা করল। কাঠ আর কাঁচের দরজা। খোলা শক্ত নয়। সাধারণ তালা। কেউ লক্ষ রাখছে কি না আড়াল থেকে কে জানে। সুতরাং ডোরবেলটা বারকয়েক বাজানোই ভাল। নজরদার তা হলে বুঝবে যে, সে ভিক্ষে চাইতেই এসেছে।
কিন্তু ডোরবেল বাজাতেই মাইক অবাক হয়ে দেখল, দরজাটা খুলে গেল। দরজা জুড়ে প্রকাণ্ড একটা শ্বেতাঙ্গ। বজ্রগম্ভীর গলায় লোকটা বলল, “কী চাও?”
মাইক ঘাবড়ে যাওয়ার মানুষ নয়। মুখটা একটু বিকৃত করে বলল, “রুটিটুটি কিছু আছে?”
“দূর হও!” বলে লোকটা দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল।
“দাঁড়াও।” বলে মাইক তার জুতো দরজার ফাঁকে ঢুকিয়ে সেটা আটকাল।