বাবুরাম ঘামছিলেন। তাঁর বমি পাচ্ছিল। বিবর্ণ মুখে ফিরে এসে গাড়িতে বসে তিনি বললেন, “প্রতিভা, একটা লোককে আমি মেরে ফেলেছি। অন্যটার কথা বলতে পারছি না।”
প্রতিভা সোজা হয়ে বসে বললেন, “যা করেছ সে তো ইচ্ছে করে নয়। না মারলে ওরাই আমাদের মারত। তোমাকে আর গাড়ি চালাতে হবে না। বনিকে নিয়ে বোসো। আমি গাড়ি চালাচ্ছি।”
বাবুরামের হাত পা থর-থর করে কাঁপছে। পাংশুমুখে তিনি বললেন, “আমাদের কি উচিত নয় ওদের হাসপাতালে নিয়ে পৌঁছে দেওয়া?”
প্রতিভা মাথা নেড়ে কঠিন গলায় বললেন, “হাসপাতালে পৌঁছে। দিলে আমাদের অনেক জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হবে।”
“এভাবে পড়ে থাকলে ওরা এমনিতেই মরে যাবে প্রতিভা।”
প্রতিভা একটু ভাবলেন। বিপদে পড়লে পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের মাথাই বেশি ঠাণ্ডা থাকে। ভেবে নিয়ে তিনি বললেন, “ডক্টর লিভিংস্টোনের ক্লিনিককে ফোন করলে কেমন হয়। পোর্টল্যাণ্ড শহরটা এখান থেকে খুব কাছে।”
বাবুরাম মাথা নেড়ে বললেন, “সেটা তবু ভাল।”
প্রতিভা গাড়ি চালাতে লাগলেন। বনিকে কোলে নিয়ে বসে বাবুরাম নিস্তব্ধ হয়ে রইলেন। চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরে পড়ছে। কষ্ট প্রতিভারও হচ্ছে। দু-দুটো লোককে ওভাবে জখম করা তো সোজা নিষ্ঠুর কাজ নয়। কিন্তু প্রতিভার বাস্তববোধ বেশি। তিনি জানেন এ ছাড়া উপায় ছিল না।
গ্যাস স্টেশনটায় এসে প্রতিভা গাড়ি থামিয়ে তেল ভরে নিতে লাগলেন। বাবুরাম গিয়ে ডক্টর লিভিংস্টোনের ছেঁড়া কার্ডটা বের করে ফোন নম্বর দেখে ডায়াল করলেন।
একজন মহিলা ফোন তুলে বললেন, “ডক্টর লিভিংস্টোনের ক্লিনিক।”
বাবুরাম কাঁপা গলায় বললেন, “ম্যাডাম, জঙ্গলের মধ্যে দুটো লোক সাঙ্ঘাতিক আহত, ওদের সাহায্য দরকার।”
“কোন জঙ্গল?”
বাবুরাম কাঁপা গলাতেই কোনওরকমে জায়গাটার বিবরণ দিলেন।
“কীরকম অ্যাকসিডেন্ট?”
“খুব গুরুতর। ওদের মেডিক্যাল অ্যাটেনশন দরকার। ওদের মোটরবাইক….”।
বাবুরাম হঠাৎ সতর্ক হয়ে গেলেন। হঠাৎ মেয়েটির গলা তীক্ষ্ণ শোনাল, “আপনি কে বলছেন?”
“আমার নাম বাবুরাম গাঙ্গুলি।”
“ওঃ।” বলে মেয়েটি এমনভাবে চুপ করে গেল যেটা বেশ সন্দেহজনক মনে হল বাবুরামের।
“আপনারা কি ব্যবস্থা নেবেন?”
মেয়েটি হঠাৎ মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করল, “এই ক্লিনিকের ফোন নম্বর আপনাকে কে দিল মিস্টার গাঙ্গুলি?”
“একটা গ্যাস স্টেশনের টেলিফোন ডিরেক্টরিতে।” বাবুরাম কোনওরকমে বানিয়ে বললেন।
“ঠিক আছে মিস্টার গাঙ্গুলি, আমাদের অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে। আপনি। স্পটের কাছে হাইওয়েতে অপেক্ষা করুন।”
“আচ্ছা।” বলে বাবুরাম ফোন ছেড়ে তাড়াতাড়ি এসে গাড়িতে উঠলেন। বনিকে সিট থেকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, “প্রতিভা, তাড়াতাড়ি করো। আমার সন্দেহ হচ্ছে ওই ক্লিনিকটা খুব সুবিধের নয়।”
প্রতিভা প্রশ্ন না করে গাড়ি ছেড়ে দিলেন। একটু এগিয়ে গিয়েই তিনি একটা একজিট ধরে হাইওয়ে থেকে নেমে অনেকটা ঘরে উলটো দিকের পথ ধরতে আবার হাইওয়েতে উঠে এলেন।
বাবুরাম চোখ বুজে ছিলেন। বিড়বিড় করে বললেন, “বাড়িতে ফিরে যাওয়াটাও এখন নিরাপদ হবে কি না কে জানে!”
“প্রতিভা দৃঢ় গলায় বললেন, “ভয় নেই, আমরা বাড়ি যাচ্ছি না।”
“তা হলে কোথায়?”
জার্সি শহরের একটু বাইরের দিকে কয়েকটা পুরনো গুদামঘরের একটা সারি আছে। এখানে কিছু ভবঘুরে আস্তানা গেড়ে আছে। পুলিশ মাঝে-মাঝে এসে জায়গাটা তল্লাশ করে যায়। প্রতিভা সোজা এসে গুদামঘরের চত্বরে গাড়ি থামালেন।
প্রথমে দু-চারটে বাচ্চা ছুটে এল। পিছনে এক বুড়ি। এরা খুব সন্দিহান স্বভাবের লোক। উগ্রও বটে। ভ ভদ্রলোকদের এরা একদম পছন্দ করে না।
বুড়ি একটু এগিয়ে এসে বলল, “কী চাই?”
প্রতিভা জিজ্ঞেস করলেন, “ফ্রেড কোথায়?”
“তোমরা কি পুলিশের লোক?”
“না। ফ্রেডকে এবং তার দলবলকে বলল, আমি বনিকে নিয়ে এসেছি। আমার সাহায্য চাই।”
এই কথাবার্তার মাঝখানেই বিভিন্ন দরজা দিয়ে কয়েকজন নোংরা চেহারার মেয়ে আর পুরুষ বেরিয়ে এল। প্রত্যেকের চেহারাতেই একটা উগ্র ভাব।
বনিকে কোলে নিয়ে বাবুরাম নেমে চারদিকে চেয়ে বললেন, “এ কোথায় নিয়ে এলে প্রতিভা? এ যে ভবঘুরেদের আস্তানা। এরা ভয়ঙ্কর লোক”।
প্রতিভা মৃদুস্বরে বললেন, “এখন এ ছাড়া উপায় নেই।”
মেয়ে পুরুষগুলো এগিয়ে এসে তাঁদের একরকম ঘিরে ফেলল। হঠাৎই তাদের মধ্যে একটি মেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “এ তো সেই বাচ্চাটা! এই তো সেই দেবশিশু! দ্যাখো, দ্যাখো, ওর চোখের রং পালটে যাচ্ছে!”
বাবুরাম আর প্রতিভাও দেখলেন। বনির কালো চোখ হঠাৎ নীলকান্তমণি হয়ে উঠেছে। যেন আলো বেরিয়ে আসছে চোখ দিয়ে।
সকলে খানিকক্ষণ পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বনির দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে একে-একে হাঁটু গেড়ে বসে ভূমি চুম্বন করল। সেই বুড়িটা প্রায় কাঁপতে কাঁপতে বলল, “তোমাদের আমরা কী সাহায্য করতে পারি?”
প্রতিভা সংক্ষেপে বললেন, “শোনো, বেশি কথা বলার সময় নেই। কিছু দুষ্টু লোক আমাদের ছেলেটাকে চুরি করতে চায়। তারা আমাকে আর আমার স্বামীকে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছে। আমরা ভারতবর্ষে চলে যেতে চাই। তোমরা আমাদের সাহায্য করবে?”
একজন পুরুষ বলল, “অবশ্যই করব। কী করতে বলল?”
“আমাদের বাড়ির ওপর ওরা নজর রেখেছে। আমাদের সেখানে যাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু আমাদের পাশপোর্ট চাই, প্লেনের টিকিট চাই। সবই আমাদের বাড়ির মধ্যে রয়েছে।”