বাবুরাম চারদিক ঘুরে দেখছিলেন। একটা ওয়েস্ট বাস্কেট ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। বাবুরাম ওয়েস্ট বাস্কেটটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দেখলেন, ভিতরে দু-চারটে জিনিস রয়েছে। তার মধ্যে একটা ডিসপোজেবল ইনজেকশন, যার উঁচটা খুব লম্বা। আর লেবেলহীন কয়েকটা ইনজেকশনের অ্যামপুল। বাবুরাম জিনিসগুলি সংগ্রহ করে একটা চামড়ার ব্যাগে ভরে নিলেন।
প্রতিভাও চারদিক ঘুরে-ঘুরে দেখছিলেন। টয়লেটটা দেখতে ঢুকলেন প্রতিভা। টয়লেটেও একটি ওয়েস্ট বাসকেট রয়েছে। প্রতিভা দেখলেন তার মধ্যে কিছু টুকরো কাগজ। তিনি টুকরোগুলো বের করলেন। দু-চারটে ব্যবহৃত টিসু পেপার। আর ভেঁড়া একটা কার্ড। কার্ডের চারটে টুকরো জুড়লেন প্রতিভা। একটা ক্লিনিকের বিজ্ঞাপন। ডক্টর লিভিংস্টোনস ক্লিনিক, পোর্টল্যান্ড, পেনসিলভানিয়া।
তিনি বাবুরামকে কার্ডটা দেখালেন। বাবুরাম সেটাও ব্যাগে ভরে নিলেন। বললেন, “আর তো কিছু দেখার নেই দেখছি।”
প্রতিভা চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “হয়তো আছে। কিন্তু আমরা তো আর ডিটেকটিভ নই।”
হতাশ হয়ে দু’জনে ওপরে উঠে এলেন। আর উঠেই শুনতে পেলেন জঙ্গল ভেদ করে একটা শক্তিশালী মোটরবাইক এগিয়ে আসছে। সম্ভবত তাঁদের দিকেই।
প্রতিভার মুখ শুকনো, “শুনতে পাচ্ছ?”
“পাচ্ছি। চলো, গাড়িতে উঠে পড়া যাক।”
প্রায় দৌড়ে গিয়ে তাঁরা দু’জন গাড়িতে উঠলেন। বাবুরাম বনিকে প্রতিভার কোলে দিয়ে বললেন, “এবার আমি চালাব। তুমি মাথা নিচু করে বসে থাকো।”
“মাথা নিচু করব কেন?”
“যদি গুলি-টুলি চালায়। ওরা কেমন লোক তা তো জানি না।”
প্রতিভা তাই করলেন। বাবুরাম গাড়িটা ঘুরিয়ে নিতে-না-নিতেই ভীমবেগে প্রকাণ্ড একটা মোটরবাইক জঙ্গল ফুড়ে ফাঁকা জায়গাটায় পড়েই ব্রেক কষল। বাইকে দু’জন লোক। দু’জনেরই মাথায় কপাল-ঢাকা টুপি, চোখে প্রকাণ্ড গগলস। মুখ দেখা যাচ্ছে না, তবে বোঝা গেল, একজন শ্বেতাঙ্গ, অন্যজন কৃষ্ণাঙ্গ। দু’জনেরই বিশাল চেহারা। তাদের গাড়িটা দেখেই একজন চেঁচিয়ে ইংরিজিতে বলল, “ওই তো ওরা! রোখো ওদের।”
জঙ্গলের রাস্তাটা সরু। মোটরবাইকটা টক করে ঘুরে গিয়ে পথটা আটকানোর চেষ্টা করল। বাবুরাম তার আগেই গাড়িটা চালিয়ে দিয়েছেন। এক সেকেণ্ডের ভগ্নাংশ সময়ের তফাতে বাবুরাম বেরিয়ে গেলেন।
কিন্তু বেরিয়ে গিয়েও ওদের হাত থেকে রেহাই পেলেন না। সরু রাস্তায় গাড়ির চেয়ে মোটরবাইক অনেক বেশি সচল। সুতরাং বাইকটা গর্জন করতে-করতে পিছু নিয়ে ধেয়ে এল।
প্রতিভা আতঙ্কিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “ওরা পিছু নিয়েছে কেন? কী চায় ওরা?”
বাবুরাম দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “ওরা ভেবেছে আমরা বনিকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি। যতদূর মনে হচ্ছে ওরা আমাদের আটকাতে চাইছে।”
বলতে বলতেই একটা গুলির শব্দ হল। বাবুরাম আয়নায় দেখলেন, বাইকের পিছনে বসা লোকটার হাতে একটা বিপজ্জনক আগ্নেয়াস্ত্র গুলিটা কোথায় লাগল কিংবা লাগল না, তা বুঝতে পারলেন না বাবুরাম। তবে তিনি গাড়িটা যতদূর সম্ভব দ্রুতবেগে চালাতে লাগলেন।
পর-পর কয়েকবার গুলির আওয়াজ হল। প্রতিভা বনিকে বুকে চেপে উপুড় হয়ে ছিলেন। বললেন, “তোমাকে যে ওরা মেরে ফেলবে।”
বাবুরাম বললেন, “বোধ হয় পারবে না। মনে হচ্ছে গাড়ির কাঁচগুলোও বুলেটপ্রুফ। ঠাকুরকে ডাকো প্রতিভা।”
হোণ্ডা গাড়িটা লাফিয়ে লাফিয়ে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা ধরে চলছে, কিন্তু মোটরবাইকটাও সমানে পাল্লা দিচ্ছে। এভাবে রেস দিয়ে কতক্ষণ পারা যাবে? বাবুরাম এ-ও জানেন, পালাতে পারলেও লাভ নেই। এরা গিয়ে এদের দলকে জানাবে এবং তাঁর গাড়ি খুঁজে বের করতে ওদের অসুবিধে হবে না। বিশেষ করে বাবুরামের পালিয়ে থাকার জায়গা নেই। সুতরাং তিনি মাথা খাটাতে লাগলেন। যেমন করেই হোক এদের নিষ্ক্রিয় করা দরকার।
জঙ্গল সব জায়গায় সমান নয়। কোথাও ঘন, কোথাও পাতলা, মাঝে-মাঝে ফাঁকা জায়গাও আছে। সামনে এরকম একটা ফাঁকা জায়গা দেখতে পেয়ে বাবুরাম দাঁতে দাঁত চেপে তৈরি হলেন। এখন তাঁকে একটা নিষ্ঠুর কাজ করতে হবে। এরকম কাজ তিনি জীবনে কখনও করেননি। তবে আত্মরক্ষার জন্য এ ছাড়া আর পথও নেই।
বাবুরাম চাপা স্বরে বললেন, “প্রতিভা, ভয় পেও না। বনিকে খুব শক্ত করে চেপে ধরে থাকো, আর নিজেও সাবধান হও। একটা ঝাঁকুনি লাগতে পারে।”
ফাঁকা জায়গাটার চারধারে বিশাল বিশাল গাছ। বাবুরাম ফাঁকায় পড়েই বাঁ দিকে বাঁক নিলেন। গাড়িটা বোধ হয় খানাখন্দে পড়ে লাফিয়ে উঠল। কিন্তু থামল না। বাবুরাম অ্যাকসেলেটরে প্রবল চাপ দিয়ে স্টিয়ারিং ডান দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। আচমকা বাঁক নিয়ে গাড়িটা উলটো মুখে ঘুরে যেতেই বাবুরাম দেখলেন মোটরবাইকটা লাফাতে লাফাতে ফাঁকায় এসে পৌঁছেছে। বাবুরাম আর দেরি করলেন না। সোজা গাড়িটা চালিয়ে দিলেন মোটরবাইকটার দিকে।
প্রবল একটা ধাতব সংঘর্ষের শব্দ হল। দু’জন লোক ছিটকে এবং খানিকটা উড়ে গিয়ে দু’ধারে পড়ল। মোটরবাইকটা একটা ডিগবাজি খেয়ে দুমড়ে-মুচড়ে গেল।
বাবুরাম গাড়ি থামালেন।
প্রতিভা সাদা মুখে বললেন, “কী হল?”
“যা হওয়ার হয়ে গেছে। তোমরা ঠিক আছ?”
“আছি।”
বাবুরাম গাড়ি থেকে নামলেন। শ্বেতাঙ্গ লোকটার মাথা একটা গাছের গুঁড়িতে লেগে থেতলে গেছে। লোকটা মরেনি বটে, কিন্তু অজ্ঞান হয়ে আছে। প্রচর রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর উইনচিটার। কালোলোকটার অবস্থা খুবই খারাপ। ওর পিস্তলের নল গলায় ঢুকে গেছে। লোকটার ঘাড়ও মনে হল ভাঙা।