অতি মস্তিষ্কের সংস্পর্শে এলে কী হয় তা বলা যায় না।”
এমন সময় ঘরের আর-একজন লোক বলে উঠল, “দেখুন ডক্টর ওয়াং, বি বি সি নিউজে কী বলছে।”
ওয়াং ঝুঁকে পড়লেন। বি বি সি’র নৈশ সংবাদে বলা হচ্ছে, চিন সরকার জানিয়েছেন, য়ুনান প্রদেশের এক জঙ্গলের মধ্যে আজ দ্বিপ্রহরে ডক্টর ওয়াং-এর মৃতদেহ পাওয়া গেছে। তাকে গুলি করে
হত্যা করা হয়েছে। সুতরাং, দেশপ্রেমী ডক্টর ওয়াং-এর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবরটি একেবারেই ভুল। তাঁর হত্যাকারীকে খোঁজা হচ্ছে।
ওয়াং সোজা হয়ে বসে বললেন, “আর দেরি নয়। এবার পালাতে হবে।”
সবাই নিঃশব্দে উঠে জিনিসপত্র গোছাতে লাগল।
৪. বিপদে পড়লে মানুষের বুদ্ধি খোলে
বিপদে পড়লে মানুষের বুদ্ধি খোলে। বাবুরাম যখনই বুঝতে পারলেন, বনি নিরাপদ নয় এবং তাঁদের ওপর কিছু লোক নজর রাখছে, তখন ঘাবড়ে গেলেও তিনি হাল ছাড়লেন না। বিপদ থেকে বুদ্ধি খাঁটিয়ে উদ্ধার পেতে হবে। এবং জানতে হবে, বনির জন্মের ভিতরে কী রহস্য আছে। সুতরাং ডেলাওয়্যার ওয়াটার গ্যাপের রাস্তায় সেই দুর্ঘটনার জায়গায় যাওয়া ঠিক করলেও তিনি গোপনে যাওয়াই স্থির করলেন। নিজের গাড়িতে যাওয়া চলবে না, গাড়িটা শত্রুপক্ষ নিশ্চয়ই চেনে। তা ছাড়া সেই পোডড়া বাড়িটায় যেতে গেলে শক্তপোক্ত গাড়ির দরকার, শৌখিন গাড়ি ধকল সইতে পারবে না।
আমেরিকায় গাড়ি কেনা খুব সহজ। যে-কোনও শহরেই গাড়ির দোকানে সারি-সারি নতুন বা পুরনো গাড়ি সাজানো আছে। নগদ টাকাতেও কিনতে হবে না, ক্রেডিট কার্ডেই কেনা যায়। বাবুরাম উইক এণ্ডের আগের দিন গাড়ির ডিলারের কাছে গিয়ে খুব দেখেশুনে একটা জাপানি হোণ্ডা গাড়ি কিনলেন। জিপগাড়ির মতোই সেটার ফোর হুইল ড্রাইভের ব্যবস্থা আছে। সেলফ সিলিং টায়ার থাকার ফলে ফুটো হওয়ার ভয় নেই। পুরু ইস্পাতের পাতে তৈরি গাড়িটা খুব মজবুত। গাড়ি কিনে তিনি সেটা বাড়ি নিয়ে গেলেন না। সেটা বোকামি হবে। ডিলারকে বললেন, একটা বিশেষ জায়গায়, পার্কের ধারে যেন গাড়িটা আজ রাতের মধ্যেই রেখে আসা হয় এবং গাড়ির চাবি যেন ডিকির ভিতরে রেখে দেওয়া হয়।
আমেরিকায় গাড়ি চুরির ঘটনা খুব কমই ঘটে। আর বেশির ভাগ গাড়িই রাস্তাঘাটেই ফেলে রাখা হয়।
শনিবার বাবুরাম আর প্রতিভা সকালে উঠে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলেন। তারা একসঙ্গে বোলেন না। বাবুরাম যেন কোনও কাজে যাচ্ছেন, এমনভাবে ব্যাগট্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিউ ইয়র্কের দিকে চলে গেলেন। আর প্রতিভা বনিকে প্যারামবুলেটারে বসিয়ে, যেন ছেলেকে নিয়ে একটু হাঁটতে বেরিয়েছেন, এমনভাবে বেরোলেন। পার্কের কাছাকাছি এসে তিনি গাড়িটা দেখতে পেলেন। চারদিকটা লক্ষ করে দেখলেন, কোনও সন্দেহজনক লোককে দেখা যাচ্ছে না। তিনি ধীরে ধীরে বনিকে নিয়ে গাড়িটার কাছে এসে ডিকি থেকে চাবিটা বের করে গাড়ির দরজা খুলে বনিকে কোলে নিয়ে উঠে পড়লেন। প্যারামবুলেটরটা পার্কে একটা ঝোঁপের ভিতরে খুঁজে দিলেন।
খুব জোরে গাড়ি চালালে পাছে কেউ সন্দেহ করে এজন্য মোটামুটি স্বাভাবিক গতিতে চালিয়ে তিনি নিউ ইয়র্কের রাস্তায় খানিক দূর এগোলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন, একটা লোক বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লিফট চাইছে।
প্রতিভা গাড়ি থামালে বাবুরাম উঠে এলেন গাড়িতে।
এর পর রুট এইট্টি ধরে সোজা পেনসিলভানিয়ার দিকে গাড়ি চালিয়ে দিলেন প্রতিভা।
জায়গাটা খুঁজে পেতে বিশেষ অসুবিধে হল না। অ্যাকসিডেন্টটা হয়েছিল একটা গ্যাস-স্টেশন সাইনের দু’ শো গজ দূরে, তাঁদের মনে আছে। পাশেই একজিট–অর্থাৎ হাইওয়ে থেকে বেরিয়ে ছোটখাটো শহর বা পল্লী অঞ্চলে যাওয়ার রাস্তা। প্রতিভা একজিট দিয়ে হাইওয়ে থেকে নেমে এলেন। কিছু দূর গিয়েই বাঁ ধারে জঙ্গলের সেই রাস্তাটা দেখতে পেলেন।
হোণ্ডা গাড়িটা সত্যিই ভাল। জঙ্গলের রাস্তায় একটু টাল খেতে-খেতে দিব্যি চলতে লাগল। ঘুমন্ত বনিকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন বাবুরাম। হঠাৎ লক্ষ করলেন, বনি চোখ মেলে তাঁর দিকে চেয়ে আছে।
ছেলেকে আদর করে বাবুরাম বললেন, “বনি, তুই কিছু বলতে চাস? খিদে পেয়েছে?”
বনি চেয়ে থাকা ছাড়া আর খাওয়া এবং ঘুম ছাড়া আর কিছুই পারে না। তবু ওকে নিয়ে কেন যে কিছু লোকের এত মাথাব্যথা!
জঙ্গল পার হয়ে গাড়িটা একটু ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ল। সামনেই সেই ঝুরঝুরে পোড়ো বাড়িটা।
বাবুরাম জিজ্ঞেস করলেন, “প্রতিভা, তোমার ভয় করছে না
প্রতিভা মাথা নেড়ে বললেন, “না। ভয় কিসের? বনির জন্য আমি সব করতে পারি।”
“তা হলে এসো, বাড়িটা ভাল করে দেখা যাক। বিশেষ করে বেসমেন্টটা।”
বাবুরাম বনিকে কোলে নিয়ে নামলেন, সঙ্গে প্রতিভা। ধীরে-ধীরে তাঁরা বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন। সাধারণ মধ্যবিত্ত আমেরিকানদের বাড়ি যেমন হয় এবাড়িটাও তেমনই। একতলায় লিভিং রুম, ড্রয়িং রুম, রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর ইত্যাদি। সবই ফাঁকা। তবে রান্নাঘরে গ্যাস উনুনটা রয়েছে। ফলে জলও আছে।
তাঁরা ধীরে-ধীরে বেসমেন্ট-অর্থাৎ মাটির তলার ঘরটিতে নামলেন। ঘরটা মাটির তলায় হলেও স্কাইলাইট দিয়ে যথেষ্ট আলো আসছে। বিশাল ঘর। এবং এ-ঘরটাও ফাঁকা। বাবুরাম সুইচ টিপলেন। অবাক কাণ্ড! আলো জ্বলল। তার মানে, বাড়িটার ইলেকট্রিক কানেকশন এখনও আছে।