দেড় মিনিট পর দ্বিতীয় কুকুরটা এল। নিঃশব্দে এবং চিতাবাঘের মতো মসৃণ গতিতে। ওয়াং এবার আগের চেয়ে তৎপরতায় কুকুরটিকে ঘুম পাড়ালেন। তৃতীয় কুকুরটা এল আরও দেড় মিনিট পর। তারপর এল চতুর্থ কুকুর।
চারটে কুকুরকে নিষ্ক্রিয় করে ওয়াং রুমালে কপালের ঘাম মুছে। নিলেন।
তাঁর হিসেবমতো মোট ছ’জন সশস্ত্র প্রহরী বাড়িটা পাহারা দিচ্ছে। সামনের দিকে চারজন, পিছনে দুজন। ওয়াং একটা ঝোঁপের আড়ালে গুঁড়ি মেরে ভাল করে চারদিকটা লক্ষ করলেন। একটা মেপল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে একজন গার্ড চুয়িংগাম চিবিয়ে। যাচ্ছিল। ওয়াং পাল্লাটা মেপে নিলেন, তারপর আর-একটা ডটপেন পকেট থেকে নিয়ে তাক করলেন। পিং করে শব্দ হল। প্রহরীটা যেন একটু চমকে উঠল। ঘাড়ে হাত দিল। তারপরই লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
এমন সময় হঠাৎ একটা বজ্রসম হাত এসে খ্যাঁক করে ওয়াং-এর ঘাড় চেপে ধরে টেনে তুলল। বিশালদেহী দ্বিতীয় পাহারাদার। ওয়াং-এর দিকে চেয়ে কর্কশ গলায় বলল, ডক্টর ওয়াং! এত রাতে লন্ডনের হাওয়া তোমার স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল নয়।
ওয়াং অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, “আমি কি তোমাদের কয়েদি?”
“না। তুমি আমাদের সম্মানিত অতিথি। সম্মানিত অতিথিরা যেমন আচরণ করে থাকেন তোমারও সেরকমই করা উচিত।”
ঝাঁকুনির চোটে ওয়াং-এর হাত থেকে ডটপেনটা পড়ে গেছে পকেটে হাত দেওয়ারও জো নেই। এরা এসব ছোটখাটো অস্ত্রের খবর রাখে। সুতরাং, এই ছ’ ফুট লম্বা দানবটির দিকে ওয়াং ভাল করে চেয়ে মাপজোখ করে নিলেন। তারপর নিরীহ হাতটি বাড়িয়ে লোকটার কবজির একটা বিশেষ জায়গা চেপে ধরলেন। অন্য হাতের একটা আঙুল অবিকল ছোরার মতো চালিয়ে দিলেন লোকটার কণ্ঠায়।
বিশাল দানবটি গোড়া-কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল।
ওয়াং ডটপেন এবং অ্যাটাচি কেসটা তুলে নিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটে দেওয়ালটার কাছে পৌঁছে গেলেন। তালাদেওয়া একটা ছোট্ট লোহার ফটক আছে, তালা এবং লোহার ফটক দুটোই অতিশয় মজবুত। পকেট থেকে আর-একটা ডটপেন বের করলেন ওয়াং। বোতাম টিপতেই তা থেকে একটা সরু বিচিত্ৰদৰ্শন ইস্পাতের মুখ বেরিয়ে এল। তালা খুলে ফেলতে দশ সেকেন্ডও লাগল না। রাস্তায় পড়েই ওয়াং অতি দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। অন্তত এক কিলোমিটার হেঁটে তিনি একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এলেন সোহে অঞ্চলের এক সরু রাস্তায়। কেমন যেন গা-ছমছম করা পরিবেশ। ঘিঞ্জি সব গরিব চেহারার বাড়ি। তারই একটার সামনে এসে নামলেন ওয়াং। ডোরবেল টিপলেন। দরজা খুলে একজন বেঁটেখাটো চেহারার চিনা মাথা নিচু করে অভিবাদন করল।
বাড়ির ভিতরে গোলকধাঁধার মতো করিডোর এবং হরেক ছাঁদের সিঁড়ি। তিন তলায় পিছনের দিকে একটা ঘরে চার-পাঁচজন নানা দেশী লোক একটা কম্পিউটার সামনে নিয়ে বসে আছে। কম্পিউটার ছাড়া টিভি মনিটরও আছে। আছে নানা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি। সকলে উঠে ওয়াংকে অভিবাদন জানাল।
ওয়াং-এর ক্রু কোঁচকানো। ঘড়ি দেখে বললেন, “এ জায়গাটার খোঁজ পেতে ওদের তিন-চার ঘণ্টার বেশি লাগবে না। সুতরাং, হাতে সময় বেশি নেই। ভিডিও ক্যাসেটটা চালাও।”
সামনের টিভির পরদায় এন বি সি নিউজের রেকর্ড করা সংবাদটিও ফুটে উঠল। সবটা নয়। শুধু বনির অংশটা। কয়েক সেকেন্ডের জন্য বনিকে দেখানোও হল। সুন্দর ফুটফুটে একটা বাচ্চা। কিন্তু সম্পূর্ণ পঙ্গু।
ওয়াং বারবার রিউইন্ড করে বনির ছবি দেখলেন। সংবাদ ভাষ্য শুনলেন। তাঁর কপালে দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠল।
বেঁটে লোকটা খুব বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “ডক্টর ওয়াং, এইটুকু একটা বাচ্চাকে নিয়ে আপনি অত দুশ্চিন্তা করছেন কেন?”
ওয়াং অত্যন্ত বিরক্তি ও রাগের সঙ্গে বললেন, “মূর্খ! বনি কে তা তোমরা জানো না। কিন্তু আমি একজন বৈজ্ঞানিক, আমি জানি। ওর চোখ দুটো ক্লোজ আপে আনো, দেখতে পাবে।”
সঙ্গে-সঙ্গে কম্পিউটারের সাহায্যে বনির মুখমণ্ডল, বিশেষ করে তার চোখ দুটো সুপার ক্লোজ আপে আনা হল। চোখ দুটি প্রাণচঞ্চল, তাতে বুদ্ধিরও যেন ঝিকিমিকি।
বেঁটে লোকটা অত্যধিক বিনয়ের সঙ্গে বলল, “তা না হয় বুঝলুম। বাচ্চাটা পঙ্গু হলেও নিবোধ নয়। কিন্তু এ আমাদের কী ক্ষতি করতে পারে? এ তো একেবারে সাত আট মাস বয়সের শিশু।”
ওয়াং ঝাঁঝালো গলায় বললেন, “যা জানো না, বোঝ না তা নিয়ে কথা বোলো না। জার্সি সিটির একটা লোকাল নিউজপেপারে কী খবর বেরিয়েছে জানো? বনি বিপদ দেখলে তার চোখের রং বদলে ফেলতে পারে।”
“না, আমি এ খবর জানতাম না। চোখের রং সে কী করে বদলায়? সেটা কি সম্ভব?”
“কী করে বদলায় তা আমিও জানি না। সেইজন্যই আমি আমেরিকা যাচ্ছি। একমাত্র উদ্দেশ্য বনিকে কজা করা। নইলে বনি আমাদের অনেক ক্ষতি করতে পারে।”
“একথাটা বুঝতে পারছি না ডক্টর।”
“তুমি বোকা, তাই বুঝতে পারছ না। বনির লক্ষণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওই পঙ্গু শিশুটি এমন একটি মস্তিষ্কের অধিকারী যা যে-কোনও মেকানিক্যাল ডিভাইসের ওপর আধিপত্য করতে পারে। যখন ও আর একটু বড় হবে তখনই ওর ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যাবে। আমি যে সুপার ব্রাট আবিষ্কার করেছি তা একটি অমিত ক্ষমতাশালী যন্ত্র। দুঃখের বিষয় সেটি কিছু বদমাশ লোক চুরি করেছে। আমি ছাড়া পৃথিবীর কেউ সেটির সম্যক ব্যবহার জানে না। কিন্তু কোনও