ডক্টর ওয়াং বিড়বিড় করে বললেন, “সব নষ্ট হয়ে গেল! সব নষ্ট হয়ে গেল!”
পাশের সিকিউরিটি গার্ড বলল, “কী নষ্ট হয়ে গেল ডক্টর ওয়াং?”
ওয়াং জবাব দিলেন না। ভ্রূকুটি করে সামনের দিকে চেয়ে রইলেন।
লন্ডনে উঁচু বাড়িঘর বিশেষ দেখা যায় না। বেশির ভাগ বাড়িই দোতলা বা তিন তলা। পুরনো বাড়ির সংখ্যা খুব বেশি। কারণ ইংরেজরা প্রাণে ধরে পুরনো কিছুই ভাঙতে বা বদলাতে চায় না। এ ব্যাপারটা ওয়াং-এর বেশ ভালই লাগে। তিনি লন্ডন শহরের দৃশ্য দেখে বেশি খুশি।
একটা মস্ত ফটকওলা বাড়ির ভিতরে গাড়িটা এসে ঢুকল। চারদিকে কড়া পাহারা। বাড়িটা লন্ডনের অন্যতম সেফ-হাউস। কাকপক্ষীও সহজে গলতে পারে না। ভিক্টোরিয় ধাঁচে তৈরি প্রকাণ্ড বাড়িটায় আরাম-বিলাসের যথেষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। আছে সুইমিং পুল, টেনিস কোর্ট, ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা, জিমন্যাশিয়াম ইত্যাদি। ওয়াং অবশ্য আরাম-বিলাসের দিকে মোটেই ভূক্ষেপ করলেন না। সোজা নিজের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে এসে টেলিফোন নিয়ে বসলেন। চটপট বোতাম টিপে নম্বর ধরলেন।
ওপাশ থেকে একটা কণ্ঠস্বর বলল, “ইয়েস।”
ওয়াং বললেন, “শোনো। আমি লন্ডনে পৌঁছেছি। এরা আমাকে একটা সেফ হাউসে তুলেছে। আমার সন্দেহ, এরা আমার টেলিফোনে আড়িপাতা যন্ত্র বসিয়ে রেখেছে এবং আমার সব কথা টেপ করা হচ্ছে। এরা চিনা ভাষাও অবশ্যই জানে। সুতরাং আমি সাঙ্কেতিক ভাষায় কথা বলছি।”
“হ্যাঁ ডক্টর ওয়াং, বুঝতে পেরেছি। আপনি কত নম্বর সঙ্কেতে কথা বলবেন?”
“চার নম্বর।”
“ঠিক আছে।”
কথা অবশ্য বেশি বললেন না ডক্টর ওয়াং। একটা সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন করলেন। একটা সংক্ষিপ্ত জবাব এল। ওয়াং এর পর তিনটি বাক্য বললেন। একটি বাক্যে জবাব এল। ডক্টর ওয়াং এর পর মোট কুড়িটি শব্দ উচ্চারণ করলেন, তার মধ্যে বারকয়েক বনি নামটা ছিল। তারপর টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন ওয়াং। তাঁর মুখে তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠল।
ওদিকে বেসমেন্ট বা মাটির নীচেকার পাতালঘরে একটি অত্যাধুনিক শব্দধারক যন্ত্রকে ঘিরে তিনজন লোক পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিল। ডক্টর ওয়াং-এব সব কথাই তারা শুনেছে এবং টেপ করে নিয়েছে। একজন অন্যজনকে বলল, “জন, চার নম্বর সঙ্কেত কাকে বলে জানো?”
“না ফ্রেড, জানি না।”
“বনি নামে কাউকে চেনো?”
“না, চিনি না।”
“তোমার কি মনে হয় না যে, ডক্টর ওয়াং অত্যন্ত ধূর্ত লোক?”
“তা তো বটেই। এশিয়াবাসীদের অধিকাংশই খুব ধূর্ত। ওয়াং আরও বেশি। তবে ধূর্ত হলেও লোকটা প্রতিভাবান। মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে বিশ্ববিখ্যাত হতে যথেষ্ট এলেম লাগে ভাই।”
“তা তো বটেই। প্রতিভার সঙ্গে ধূতামি যোগ হলে খুবই বিপজ্জনক। অথচ লোকটাকে দেখলে হাসিই পায়।”
“আর হেসো না ফ্রেড। ডক্টর ওয়াং মোটেই হাসির খোরাক নন। আমার মনে হয় লন্ডনে ওঁর অনেক শাগরেদ আছে। যার সঙ্গে উনি কথা বললেন সেও একজন। ফোন নম্বরটা কোথাকার বলো তো?”
ফ্রেড মাথা নেড়ে বলল, “ডক্টর ওয়াং তোমার বা আমার চেয়ে অনেক বেশি ধূর্ত জন। ফোনটা করেছেন উনি চেরিং ক্রস আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের একটি পাবলিক বুথের নম্বরে। লোকটি ওই বুথে ঢুকে অপেক্ষা করছিল। সবই আগে থেকে ঠিক করা ছিল নিশ্চয়ই।”
“সে তো বটেই। বনি নামটা মনে রেখো। আমাদের জানতে হবে এই বনি কে।”
“আমাদের সবই জানতে হবে ফ্রেড!”
“কিন্তু কাজটা খুব সহজ হবে না জন।”
ওদিকে ফোন করার পর ডক্টর ওয়াং খুব খুশির ভাব দেখাচ্ছেন। তিনি গরম জলে স্নান করলেন এবং খুশির চোটে স্নান করতে করতে চিনা ভাষায় একটু গানও করলেন। বলা বাহুল্য, তাঁর গানের গলা নেই।
স্নানের পর তিনি খাবার ঘরে গিয়ে দেখলেন অতি সুস্বাদু সব চিনা খাবার তাঁর জন্য সাজিয়ে রেখে সেবকেরা অপেক্ষা করছে।
সন্দেহাকুল গলায় তিনি প্রশ্ন করলেন, “খাবারে বিষ নেই তো? বা ঘুমের ওষুধ?”
খেয়ে উঠে তিনি তাঁর ঘরে এসে কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। তারপর টিভি খুলে খবর শুনতে লাগলেন। বি বি সি’র সংবাদে ডক্টর ওয়াং সম্বন্ধে খবরে বলা হল, চিন সরকার জানিয়েছেন ডক্টর ওয়াং মোটেই চিন ছেড়ে পালিয়ে যাননি। তিনি চিনেই আছেন। তাঁর পালিয়ে যাওয়ার খবরটি সম্পূর্ণ বানানো।
ডক্টর ওয়াং সামান্য হাসলেন। ধীরে ধীরে রাত্রি গম্ভীর হল। ওয়াং ঘড়ি দেখলেন। তারপর টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে তিনি বাইরে বেলোনোর পোশাক পরে নিলেন। অ্যাটাচি কেসটা খুলে তিনি চারটে ডটপেন বের করে তিনটে পকেটে গুঁজে রাখলেন, একটা নিলেন ডান হাতে। তারপর ঘরের আলো নিবিয়ে পনেরো মিনিট অপেক্ষা করার পর দরজা খুলে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলেন।
লিভিং রুম পেরিয়ে বাইরে বেরোনোর দরজা। দরজার বাইরে অবশ্যই পাহারাদার আছে। আছে শিকারি ককরও। সুতরাং, সেদিকে গেলেন না ওয়াং, তিনি ডানধারে একটা জানালার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে দেখলেন। মস্ত লন। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ফ্লাড লাইটের আলোয় জায়গাটা দিনের বেলার মতোই ঝকঝক করছে।
জানালাটা খুলে ওয়াং লঘু পায়ে একটা লাফ দিয়ে নীচে। পড়লেন। কোনও শব্দ হল না বটে, কিন্ত প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিদ্বেগে একটা ডোবারম্যান ককর ছুটে এসে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওয়াং দেওয়ালে সিঁটিয়ে গিয়ে কুকুরটার চেয়েও তৎপরতায় ডটপেনটা তুলে বোম টিপতেই পিং করে একটা সূক্ষ্ম উঁচ গিয়ে কুকুরটার গলায় বিঁধল। তিন সেকেন্ডের মধ্যে নেতিয়ে পড়ল কুকুরটা। ওয়াং নড়লেন না। দ্বিতীয় কুকুরটা অবশ্যই আসবে।