“লোক দুটোকে তোমার পাজি বলে মনে হচ্ছে কেন?”
“ওদের কথাবার্তায় একটা লোককে খতম করে দেওয়ার প্রসঙ্গও আছে। তবে খুব স্পষ্ট করে নয়। যাই হোক, এরা যে ভাল লোক নয় তা বুঝতে কষ্ট হয় না। লোক চরিয়েই আমি বুড়ো হলুম।”
ক্যাসেটটা নিয়ে গদাইবাবু বাড়ি ফিরে এলেন। এসে দেখলেন, পাড়ায় লোডশেডিং চলছে এবং তাঁর বাড়িতে যথারীতি ঝলমল করছে আলো। বাইরের ঘরে আজও গগনবাবু আর শান্তিবাবু এসে বসেছেন। টিভি চলছে। দেখানো হচ্ছে বি বি সি’র খবর। গদাইবাবু খুবই চিন্তিতভাবে বসে খবর শুনতে লাগলেন। খবরটা তাঁর কাছে বেশ গুরুতরই মনে হল। বি বি সি’র সংবাদপাঠক বললেন, “বিশ্ববিখ্যাত চিনা বৈজ্ঞানিক ডক্টর ওয়াং হংকং-এ মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। শীঘ্রই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রওনা হবেন। যে আবিষ্কারকে নিয়ে তাঁর অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা হংকং থেকে চুরি হওয়ায় সারা বিশ্বে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এই আবিষ্কার খুঁজে বের করতে আন্তজাতিক গোয়েন্দাবাহিনীর সাহায্য চাওয়া হয়েছে। তবে এই আবিষ্কারটি ঠিক কী বস্তু তা ডক্টর ওয়াং স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। ওদিকে চিনের তরফ থেকে ডক্টর ওয়াং-এর এই আচরণের তীব্র নিন্দা করা হয়েছে।”
৩. প্যান অ্যাম-এর একটি বোয়িং ৭৪৭
প্যান অ্যাম-এর একটি বোয়িং ৭৪৭ জাম্বো জেট বিমানের প্রথম শ্রেণীতে আজ একজন ভি আই পি হংকং থেকে লন্ডন যাচ্ছেন। বিমানসেবক ও সেবিকারা তটস্থ। বিমানটি কিছুক্ষণ পরেই লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে নামবে। ভি আই পি যাত্রীটি অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে মাঝে-মাঝে তাঁর দামি হাতঘড়িটির দিকে চেয়ে দেখছেন। ভূ কোঁচকানো, চ্যাপটা মুখে রাজ্যের বিরক্তি এবং উৎকণ্ঠা। তাঁর সামনে ও পিছনের দুটি-দুটি চারটি সারিতে সাদা পোশাকের দেহরক্ষীরা বসে আছে। তাদের সকলেরই চেহারা কুস্তিগির বা মুষ্টিযোদ্ধাদের মতো। প্রত্যেকের কাছেই শক্তিশালী ওয়াকিটকি, আগ্নেয়াস্ত্র ইত্যাদি রয়েছে।
ভি আই পি যাত্রীটির জন্য খাদ্য পানীয়ের কোনও অভাব নেই। কিন্তু তিনি কোনও খাদ্যই গ্রহণ করেননি। শুধু একবার খানিকটা জল খেয়েছেন, তাও সন্দিহান মুখে। এমনকী বিমানসেবিকাকে তিনি ভাঙা-ভাঙা ইংরিজিতে জিজ্ঞেসও করেছেন, জলের মধ্যে বিষ বা ঘুমের ওষুধ নেই তো!
ভি আই পি যাত্রীটি হচ্ছেন চিনের দেশত্যাগী বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ ডক্টর ওয়াং। তাঁর বেঁটেখাটো, পেটমোটা চেহারাটা দেখলে কিছুতেই তাঁকে বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক বলে মনে হয় না। বরং কমিক চরিত্রের অভিনেতা বলেই বেশি মনে হয়। ডক্টর ওয়াং খুবই অস্থিরচিত্ত মানুষ। তিনি স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছেন না। অন্তত দশবার টয়লেটে গিয়ে মুখে-চোখে জলের ঝাঁপটা দিয়েছেন। বারবার রুমালে মুখ মুছছেন। বিড়বিড় করে কথা বলছেন। আপনমনে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাচ্ছেন। অন্তত বিশবার বিমানসেবিকাকে প্রশ্ন করেছেন, লন্ডন পৌঁছতে আর কতক্ষণ লাগবে।
তাঁর নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে চাপাস্বরে কথা বলে হাসাহাসি করছে।
আজ প্রথম শ্রেণীতে যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। ডক্টর ওয়াং বসেছেন সামনের দিকে। পিছনের দিকে মাত্র কয়েকজন যাত্রী আছেন। তাঁরা সবাই শ্বেতাঙ্গ। কোনও এশিয়াবাসীকে আজ প্রথম শ্রেণীতে উঠতে দেওয়া হয়নি।
হঠাৎ বিমানে ঘোষণা হল, বিমান আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হিথরো বিমানবন্দরে নামবে।
ওয়াং খুব উত্তেজিত হয়ে উঠে পড়লেন। ফের বসলেন। জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখলেন।
একটু বাদেই লন্ডন শহরের বিপুল বিস্তার দেখা গেল। লন্ডন ওয়াং-এর কাছে অচেনা জায়গা নয়। তিনি বহুবার বিভিন্ন কনফারেন্সে যোগ দিতে লন্ডনে এসেছেন। তবু যেন প্রথম দেখছেন এমন কৌতূহল নিয়ে চেয়ে রইলেন নীচের দিকে।
বিমান ধীরে-ধীরে নামল এবং একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ভূমিস্পর্শ করল।
ওয়াং তাড়াতাড়ি তাঁর অ্যাটাচি কেসটা নিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন, একজন সিকিউরিটি গার্ড তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে পথ আটকে বলল, “ডক্টর, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আপনার নিরাপত্তার জন্য আপনাকে আমরা অন্য দরজা দিয়ে নামাব।”
ডাক্তার ওয়াং রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন, “মূর্খ। আমাকে বেশি গুরুত্ব দিলে শত্রুপক্ষের নজর আমার ওপরেই বেশি পড়বে–এটাও জানো না? আমাকে অন্যান্য যাত্রীর সঙ্গে মিলেমিশে নামতে দাও।”
নিরাপত্তারক্ষী মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের ওপর হুকুম আছে, পাইলটের পাশের দরজা দিয়ে আপনাকে নামাতে হবে।”
ডক্টর ওয়াং হতাশভাবে মাথা নাড়লেন।
প্লেনের সামনের ডান দিকে যে-দরজা দিয়ে খাবারদাবার ইত্যাদি বিমানে ভোলা হয় ওয়াংকে নিয়ে নিরাপত্তারক্ষীরা সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল। নীচে একখানা গাড়ি টারম্যাকে অপেক্ষা করছিল। বুলেট প্রুফ গাড়ি। সামনে ও পিছনে দুটি পুলিশের গাড়ি।
ডাক্তার ওয়াং খুব বিরক্তির সঙ্গে এসব লক্ষ করলেন। প্রতিবাদ করে লাভ নেই বলে প্রতিবাদ করলেন না। সোজা গিয়ে গাড়িটায় উঠে বসলেন। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ছুটে চলল। তাঁকে পাশপোর্ট দেখিয়ে ইমিগ্রেশনের বাধা টপকাতে হল না। গাড়ি বিমানবন্দর পেরিয়ে ছুটে চলল হ্যাঁরোর দিকে।