“আবিষ্কারটি কী এমন যা আনাড়ির হাতে পড়লে ক্ষতি হতে পারে?”
“খুবই পারে। অসাবধানে ওটি ঘাঁটাঘাঁটি করলে সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হয়ে যেতে পারে। সেসব কাণ্ডের কথা আর না-ই বা বললাম।”
“কীভাবে ওটি চুরি গেল তা একটু বলুন।”
“তাইওয়ানে আসার পর আমি একটি হোটেলে ছিলাম। হংকং-এর একটি বড় হোটেল। ঘর থেকে আমি বড় একটা বেরোতুম না। নিজের পরিচয়ও কাউকে দিতাম না। সারাদিন হোটেলের ঘরে নিজের বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতাম। তবে হোটলের কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটা পছন্দ করেনি। হোটেলের ঘরে বিজ্ঞানচর্চা তারা আমাকে করতে বারণ করে। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার ঘর ফাঁকা, সব যন্ত্রপাতি হাওয়া, সেইসঙ্গে আমার সব মালপত্রও। আমি চেঁচামেচি হইচই বাধিয়ে দিই। প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল, হোটেলওয়ালাই চুরিটা করিয়েছে আমাকে তাড়ানোর জন্য। পরে পুলিশ আসে এবং তারা নানারকম তদন্ত করে আমাকে জানায়, এটা বাইরের লোকের কাজ। এই হোটেলের খুবই সুনাম আছে, এখান থেকে কারও কিছু চুরি যায়নি কখনও।”
“আপনার কাকে সন্দেহ হয় ডাক্তার ওয়াং?”
“দেখুন, আমি পরিচয় না দিলেও বিশ্ব-দুনিয়ায় বৈজ্ঞানিক মহলে। সবাই আমায় চেনে। আমার ছবি পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞান জানালে বেরোয়। আমার সন্দেহ, হংকং-এ আমাকে কেউ চিনতে পেরেছে এবং সে আমার আবিষ্কারের কথাও জানে। সম্ভবত আমার রাতের খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়ে চুরিটা করা হয়েছে।”
“আপনি এখন কী করবেন?”
ডাক্তার ওয়াং অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে মষ্টিবদ্ধ হাত শন্যে ঘঁসি মারার ভঙ্গিতে ছুঁড়ে বললেন, “চোরদের আমি ছেড়ে দেব না। আমি সারা দুনিয়া চষে বেড়িয়ে আমার আবিষ্কারটি খুঁজব, চোরদের এমন শাস্তি দেব যে, তারা চিরদিন মনে রাখবে।”
এর পরই টিভিতে আবার কলকাতার প্রোগ্রাম চলে এল।
শান্তিবাবু বললেন, “গদাইবাবুর বাড়িতে এসে আজ অনেক লাভ হল। ফাঁকতালে আমেরিকা আর হংকং-এর খবর পেয়ে গেলুম।”
পাড়াপ্রতিবেশীরা বিদায় নেওয়ার পর গদাইবাবু খুব ভাল করে তার টিভি সেটটা লক্ষ করলেন। সেই পুরনো সেটটাই রয়েছে, কেউ বদলে দিয়ে যায়নি। টমটমকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ রে, এর মধ্যে কি কোনও মিস্ত্রি এসে আমাদের টিভি সেটটা মেরামত করেছে?
“না তো! আমার কি মনে হয় জানো বাবা? আমার মনে হয় আমাদের বাড়ির কোনও একটা ভালমানুষ ভূত এসে বাসা করেছে।”
গদাইবাবু অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, “ভূত বলে কিছু নেই। সবই বিজ্ঞান।”
তা হলে লোডশেডিং-এর মধ্যে আলো জ্বলছে কী করে? টিভিটা রঙিন হল কী করে?”
গদাইবাবু মুখে কিছু বললেন না, কিন্তু তাঁর মনেও নানা প্রশ্নের উদয় হচ্ছে, সেদিন মাঝরাতে চা করে দিল কে? বাচ্চা মেয়েটাকে খাট থেকে নামিয়ে মাদুর পেতে বসাল কে? এই সব কী হচ্ছে? অ্যাঁ! ভূত তিনি মুখে না মানুন, কিন্তু মনের মধ্যে বেশ একটা ভূত-ভূত ভয় যে না হচ্ছে এমন নয়। কিন্তু এই বিজ্ঞানের যুগে। ভূতকে স্বীকারই বা তিনি করেন কী করে?
রাত্রিবেলা গদাইবাবুর ঘুম হচ্ছিল না। নানা কথা ভেবে মাথাটা গরম। হঠাৎ তাঁর মনে হল, নিশুত রাতে কে বা কারা যেন রেডিও বা বেতারযন্ত্র চালু করেছে। তিনি নানারকম ধাতব কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিলেন। গদাইবাবু টর্চ আর লাঠি নিয়ে উঠলেন এবং সব ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিলেন। রেডিওটার কাছে গিয়ে দেখলেন, সেটা থেকেই শব্দ আসছে। কোন কেন্দ্র থেকে কথা আসছে তা বুঝতে পারলেন না, তবে ভাষাটা চিনা বা জাপানি হতে পারে। কিছুক্ষণ শুনে বুঝলেন এটা কোনও বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠান নয়। একজন যেন আর-একজনের সঙ্গে বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে কথা বলছে। আরও কিছুক্ষণ শুনবার পর তাঁর মনে হল, এটা একটা লং ডিসট্যান্স টেলিফোন কল। তাঁর রেডিও ওই কলটাকে মনিটর করছে। গদাইবাবুর ছোট্ট ট্রানজিস্টর রেডিও খুবই কমজোরি যন্ত্র। দামেও শস্তা। সাধারণত কলকাতা কেন্দ্রেরই অনুষ্ঠান স্পষ্ট শোনা যায়। ব্যাটারিটাও পুরনো হয়েছে। এই রেডিওতে এসব ব্যাপার হওয়ার কথাই নয়।
হঠাৎ গদাইবাবুর মাথায় চিড়িক করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি তাড়াতাড়ি তাঁর টেপরেকর্ডারটা এনে রেডিওর কথাগুলো রেকর্ড করতে লাগলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল এই দুটি লোকের কথার মধ্যে কোনও একটা রহস্য থাকলেও থাকতে পারে। রেকর্ড করার আরও একটা কারণ ছিল। কথাবাতার মধ্যে তিনি বারবার ডাক্তার ওয়াং-এর নাম উচ্চারিত হতে শুনতে পেয়েছিলেন।
বেন্টিং স্ট্রিটের একটা চিনে দোকান থেকে বহুঁকাল ধরে জুতো কেনেন গদাইবাবু। চেনা দোকান। লোকটা তাঁকে খাতিরও করে। পরদিন অফিসের পর তিনি সোজা গিয়ে সেই দোকানের চিনা মালিককে ধরলেন, এই ক্যাসেটের কথাবাতাগুলোর অর্থ বলে দিতে হবে। মনে হচ্ছে ভাষাটা চিনা।
লোকটা খুব খাতির করে দোকানের পিছন দিকে একটা ছোট্ট ঘরে। নিয়ে গদাইবাবুকে বসাল তারপর তার ছেলেকে ডেকে বলল, “তোমার ওয়াকম্যানটা নিয়ে এসো।”
ওয়াকম্যান এলে লোকটা কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে মন দিয়ে কথাবাতাগুলো শুনে বলল, “গদাইবাবু, ভাষাটা ক্যান্টোনিজ চিনা। মনে হচ্ছে দুটো পাজি লোক কোনও শলাপরামর্শ করছে। ডাক্তার ওয়াং কাল লন্ডন রওনা হচ্ছেন, সেখানে যেন তাঁকে রিসিভ করা হয়। সেকথাই বলছে। আর একটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথাও আছে। আর আছে পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার দামের কথাও। কিসের দাম তা অবশ্য আমি বুঝতে পারছি না।”