চা তিনি নিলেন এবং চুমুকও দিলেন। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, “ভূতের চা বাবা, খেয়ে না আবার কোনও গণ্ডগোলে পড়ি। তবে উপকারী ভূত, এইটেই যা সান্ত্বনা।”
কিন্তু এই বিজ্ঞানের যুগে ভূতকেই বা মানেন কী করে গদাইবাবু? যতই ভূতুড়ে কাণ্ড হোক তার পিছনে একটা বৈজ্ঞানিক কারণ থাকবেই থাকবে। বিজ্ঞান ছাড়া কিছুই ঘটছে না।
চা খুবই ভাল হয়েছে। চা খেয়েই তাঁর বেশ ফুরফুরে লাগল এবং ঘুমও পেল। তিনি বিছানায় শুয়ে অঘোর ঘুমে ঢলে পড়লেন।
পরদিন বিকেলে যে কাণ্ড ঘটল তার জন্য অবশ্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। পরদিনও সন্ধেবেলায় চারদিকে লোডশেডিং এবং যথারীতি গদাইবাবুর বাড়িতে আলো জ্বলছে। পাড়ার দু-চারজন ব্যাপারটা দেখতে এসেছেন।
পটলবাবু বললেন, “নাঃ গদাইবাবু, আপনার কপালটা বড্ডই ভাল। ইলেকট্রিক কোম্পানির ভুলে আপনি দিব্যি লোডশেডিং-এর হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন।”
গদাইবাবু খুব ম্লান একটু হাসলেন।
বাইরের ঘরে টিভি চলছে, তাতে বাচ্চাদের কীসব প্রোগ্রাম দেখানো হচ্ছে।
হঠাৎ শান্তিবাবু বললেন, “আরে! দেখুন তো, এটা টিভিতে কী দেখাচ্ছে! এ তো আমাদের দেশের প্রোগ্রাম নয়।”
সবাই অবাক হয়ে দেখলেন, গদাইবাবুর সাদা কালো টিভির পরদায় রঙিন ছবি আসছে। আমেরিকার এন বি সি’র নিউজ চ্যানেলে একজন শ্বেতাঙ্গ খবর পড়ছেন।
গগনবাবু বলে উঠলেন, “গদাই, তোমার তো রঙিন টিভি ছিল! কবে কিনলে?”
গদাইবাবু আমতা আমতা করে বললেন, “এই আর কি।”
শান্তিবাবু বলে উঠলেন, “কিন্তু এইমাত্র যে সাদা-কালো ছবিই দেখা যাচ্ছিল।”
গাইবাবু একথাটা না-শুনবার ভান করলেন। কারণ আসল কথাটা হল তাঁর রঙিন টিভি নেই। অথচ চোখের সামনে তাঁর সাদা-কালো টিভিতে দিব্যি বাহারি রঙের ছবি দেখা যাচ্ছে। আর প্রোগ্রামটা দেখার মতো। এন বি সি নিউজ। এন বি সি .যে আমেরিকার একটি সংস্থা তা তিনি ভালই জানেন।
শান্তিবাব বললেন, “হয়তো হতেও পারে যে, আমেরিকার প্রোগ্রাম এখান থেকে রিলে করে দেখানো হচ্ছে। পাড়ায় লোডশেডিং না হলে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা যেত আশপাশের বাড়িতে।”
গদাইবাবু চুপ করে রইলেন, কারণ তিনি নিজেও বেশ ব্যোমকে গেছেন।
যাই হোক, সবাই মিলে টিভির এই নতুন ধরনের প্রোগ্রামটা মন দিয়েই দেখতে লাগলেন। হঠাৎ খবরে বলল, “এখন তোমাদের কাছে আমরা একটি অদ্ভুত শিশুকে হাজির করছি। ছেলেটির নাম বনি। এ হল বাবুরাম আর প্রতিভা নামক একটি ভারতীয় দম্পতির শিশুপুত্র। এ-ছেলেটির শরীর অসাড়, সে শব্দ করে না, কাঁদে না, হাসে না, কিন্তু ডাক্তার ক্রিল বলেছেন, ছেলেটির মস্তিষ্ক খুবই উন্নত মানের। এরকম শিশু পৃথিবীতে দুর্লভ।”
খবরের সঙ্গে-সঙ্গে একটি শিশুর ছবি টিভিতে দেখানো হল। ভারী সুন্দর চেহারা বাচ্চাটার। কিন্তু সে অসাড়।
গদাইবাবু এসব দেখছেন আর সকলের অলক্ষে চোখ কচলাচ্ছেন, নিজের গায়ে চিমটিও কাটছেন। স্বপ্ন দেখছেন কি না বুঝতে পারছেন না। নাকি পাগল হয়ে গেলেন? লোডশেডিং-এর মধ্যে ঘরে আলো জ্বলছে, সাদাকালো টিভিতে রঙিন ছবি দেখা যাচ্ছে, কলকাতায় বসে আমেরিকার এন বি সি’র খবর শুনছেন–এসবের মানে কী?
হঠাৎ টিভির ছবি পালটে গেল। দেখা গেল হংকং থেকে এক ভদ্রমহিলা খবর পড়ছেন। তিনি খবরের যে অংশটা পড়ছিলেন তাতে জানা গেল, সম্প্রতি চিন থেকে নাকি একজন বৈজ্ঞানিক অনেক কষ্টে তাইওয়ানে পালিয়ে এসেছেন। তাঁর নাম ডাক্তার ওয়াং। তিনি নাকি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু তাঁর দেশের বৈজ্ঞানিক অকাঁদেমি সেই আবিষ্কারটি তাঁদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানান। তিনি সেই দাবি মানেননি। ফলে তাঁকে গ্রেফতার করার হুমকি দেওয়া হয়। তিনি কয়েকজন বন্ধুর সাহায্যে তাঁর আবিষ্কারটি নিয়ে পালিয়ে আসেন।
টিভির পরদায় ডাক্তার ওয়াংকে দেখা গেল। বেঁটে-খাটো মাঝবয়সী একজন লোক। চেহারাটা দেখে হাসিই পায়। যেন কুমড়োপটাশ। চোখমুখে আতঙ্ক। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, “ডাক্তার ওয়াং, আপনি কোন কৌশলে পালালেন?”
ওয়াং রুমালে মুখ মুছতে-মুছতে বললেন, “আমাদের দেশে একরকম ভেষজ আছে, তার নাম জিন সেং। সেটা খুব রফতানি হয় বড়বড় প্যাকিং বাক্সে। ওরকমই একটা প্যাকিং বাক্সের মধ্যে আমি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ঢুকে পড়ি, আমার আবিষ্কারটি সঙ্গে ছিল। তাইওয়ানে এসে পৌঁছতে আমার কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু এ-দেশটা আরও বিচ্ছিরি।”
“কেন ডাক্তার ওয়াং? হংকং তো খুব উন্নত শহর?”
“শহর উন্নত হলে কী হবে? এদেশে আসবার সঙ্গেসঙ্গেই আমার আবিষ্কার চুরি হয়ে যায়। সেই থেকে আমার রাতে ঘুম নেই, ভাল করে খেতে পারি না…”
বলতে বলতে ওয়াং রুমালে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। চিনা বা জাপানিরা সহজে কাঁদে না। কান্না তাদের ধাতেই নেই। এমনকী ওসব দেশে বাচ্চাদেরও খুবই কম কাঁদতে দেখা যায়। সুতরাং, বোঝা গেল, ডাক্তার ওয়াং খুবই মনোকষ্টে আছেন।
“আপনার আবিষ্কারটি ঠিক কী ধরনের তা কি একটু দয়া করে বলবেন?”
ডাক্তার ওয়াং চোখ মুছে বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বললেন, “আবিষ্কারটি এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। হলে সারা পৃথিবীতে হইচই পড়ে যাবে। তবে ও-বিষয়ে আমি খোলাখুলি কিছুই বলব না। তা হলে যারা জিনিসটা চুরি করেছে তারা জো পেয়ে যাবে।”