- বইয়ের নামঃ বনি
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. বাবুরাম গাঙ্গুলি খুব মেধাবী
বনি
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
বাবুরাম গাঙ্গুলি খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এনজিনিয়ারিং পাশ। করে আরও পড়াশুনার জন্য তিনি আমেরিকায় চলে যান এবং উচ্চশিক্ষার পর সেখানেই খুব ভাল চাকরি পেয়ে থেকে গেলেন।
বাবুরাম গাঙ্গুলির অবস্থা খুবই ভাল। বহু টাকা রোজগার করেন। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহর থেকে মাত্র চল্লিশ মাইল দূরে একটি ছোট্ট শহরে তিনি থাকেন স্ত্রী প্রতিভার সঙ্গে। বিশাল বাড়ি, তিনটে দামি গাড়ি আছে তাঁদের। একটা বাবুরামের, একটা প্রতিভার আর একটা স্ট্যান্ডবাই।
বাবুরামের সবই আছে। কিন্তু দুঃখ একটিই। বিয়ের দশ বছর পরেও তাঁদের কোনও সন্তান হয়নি। সন্তান না থাকলে মানুষের কাছে গাড়ি বাড়ি টাকা-পয়সা সবই অর্থহীন হয়ে যায়। বাবুরাম আর প্রতিভার কাছেও জীবনটা ভারী অর্থহীন হয়ে উঠছিল।
এমন সময় একটা ঘটনা ঘটল।
বাবুরাম আর প্রতিভা উইক এন্ডে বেড়াতে বেরিয়েছেন। তাঁরা যাবেন পেনসিলভানিয়ার পোকোনো জলপ্রপাত দেখতে। সকালবেলা। আশি নম্বর হাইওয়ে ধরে বাবুরাম গাড়ি চালাচ্ছেন। পাশে বসে প্রতিভা ম্যাপ দেখে রাস্তা ঠিক করছেন। ডেলাওয়ার ওয়াটার গ্যাপের কাছবরাবর যখন চলে এসেছেন তাঁরা তখন হঠাৎ বাবুরাম ভারী অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ পাশের লেন দিয়ে একটা মস্ত গাড়ি তাঁর গাড়িকে পেরিয়ে যাচ্ছিল,সেই গাড়িতে অনেকগুলো বাচ্চার হাসিমুখ দেখতে পেয়েই বোধ হয় তাঁর নিজের শূন্য জীবনটার জন্য ফের দুঃখ হচ্ছিল। আর এই অন্যমনস্কতার মধ্যেই কিছু একটা ঘটে গেল। কী ঘটেছিল তা বাবুরাম জানেন না। পরে তাঁর মনে পড়েছিল, তিনি একটা প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন, তারপরই গাড়িটা রাস্তার ধারে তীরবেগে উলটে পড়ে যাচ্ছিল। বাবুরাম জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলেন তিনি একটা ঘরে শুয়ে আছেন। শুয়ে আছেন, কিন্তু বিছানায় নয়, মেঝের ওপর। গায়ে হাতে পায়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে তিনি উঠে বসে দেখলেন, একটু দূরে মেঝের ওপর প্রতিভাও পড়ে আছে। বাবুরাম পরীক্ষা করে দেখে নিশ্চিন্ত হলেন যে, প্রতিভাও বেঁচে আছে। তাদের কারও আঘাতই খুব গুরুতর নয়।
গাড়ি দুর্ঘটনার কথা বাবুরামের মনে পড়ল, কিন্তু এই বাড়ির মধ্যে তাঁরা কী করে এলেন তা বুঝতে পারলেন না। বাড়িতে লোকজন বা আসবাবপত্র কিছুই নেই। পরিত্যক্ত বাড়ি। দেওয়ালে অনেক ফুটো, মেঝের তক্তা ভাঙা,। হাইওয়ে থেকে অনেকটা দূরেই এই বাড়ি। কেউ যদি তাদের তুলে এনে এখানে রেখে গিয়ে থাকে তো সে অদ্ভুত লোক। হাসপাতালে নিয়ে না গিয়ে এরকম একটা পোড়া বাড়িতে তাঁদের আনার মানে কী?
বাড়িতে একটা ছোট সুইমিং পুল ছিল। তা থেকে জল এনে প্রতিভার চোখে-মুখে ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরালেন বাবুরাম। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দুজনে বেরোলেন। আশেপাশে লোকবসতি নেই। ঘন জঙ্গল। তবে একটা কাঁচা রাস্তা আছে।
প্রায় মাইল-দুই হেঁটে তবে তাঁরা দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন। গিয়ে দেখলেন, গাড়িটি নেই। লোকজনও কেউ জমায়েত হয়নি সেখানে।
বাবুরাম হঠাৎ নিজের ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলেন, সকাল ন’টা বাজে। দুর্ঘটনা ঘটেছে সকাল আটটা নাগাদ। এত তাড়াতাড়ি গাড়িটা সরাল কে? আমেরিকা কাজের দেশ বটে, কিন্তু তা বলে এত তাড়াতাড়ি তো এরকম হওয়ার কথা নয়।
হঠাৎ বাবুরামের চোখ গেল ঘড়ির তারিখের খোপে। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, বারো তারিখ, সোমবার। এরকম তো হওয়ার কথা নয়। আজ তো দশ তারিখ, শনিবার।
“প্রতিভা, তোমার ঘড়িটা দ্যাখো তো আজ কত তারিখ এবং কী। বার?”
প্রতিভাও ঘড়ি দেখে অবাক হয়ে বললেন, “ও মা, এ তো দেখছি সোমবার আর বারো তারিখ।”
“সেটা কী করে সম্ভব? আমরা কি দু’দিন অজ্ঞান হয়ে ছিলাম?”
“অসম্ভব।”
বাবুরাম খুবই চিন্তিত হলেন। দুদিন অজ্ঞান হয়ে থাকলে তাঁদের প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ার কথা। প্রচণ্ড খিদে-তেষ্টাও পাওয়ার কথা। কিন্তু ততটা দুর্বল তাঁরা বোধ করছেন না। তবে এমনও হতে পারে, দুর্ঘটনার ধাক্কায় তাঁদের ঘড়ি বেগড়বাই করছে।
দু’জনে আরও মাইল-দুই হেঁটে একটা গ্যাস স্টেশন পেলেন। অর্থাৎ পেট্রল পাম্প। সেখান থেকে একটা এজেন্সিতে ফোন করলেন একখানা গাড়ি পাঠাতে। রেস্টরুমে গিয়ে দু’জনেই হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে একটা করে কোকাকোলা খেলেন। গ্যাস স্টেশনের লোকটিকে আজ কত তারিখ তা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলেও বাবুরাম লজ্জা পাচ্ছিলেন। প্রশ্ন শুনলে লোকটা তাঁকে হাঁদা মনে করে হাসবে। কিন্তু পেট্রল পাম্পের সামনেই খবরের কাগজের স্লট মেশিন রয়েছে। বাবুরাম পয়সা ঢুকিয়ে একখানা খবরের কাগজ বের করে দেখলেন। যা দেখলেন তা অবিশ্বাস্য। আজ যথার্থই বারো তারিখ। বাবোই সেপ্টেম্বর। সোমবার।
প্রতিভাকে আড়ালে ডেকে বাবুরাম বললেন, “আমরা য়ে দু’দিন অজ্ঞান হয়ে ছিলাম তাতে কোনও সন্দেহই নেই। আজ বারোই সেপ্টেম্বর। কিন্তু আমরা এমন কিছু চোট তো পাইনি যাতে দু’দিন অজ্ঞান হয়ে থাকার কথা।”
প্রতিভা অত্যন্ত ভয় পেয়ে বললেন, “শুধু তাই নয়। আমাদের দুজনকে দু’মাইল দূরে ওই পোডড়া বাড়িতেই বা নিয়ে গেল কে? কেনইবা নিল?”