বাঞ্ছারাম মাথা নেড়ে বললেন, “আমার ছেলেকে তোমরা মেরো না। ফরমুলা নিয়ে যাও।”
“সেটা কোথায় আছে?”
“বোধহয় ওই আলমারিতে। ওই যে লোহার আলমারি। খোলাই আছে।”
বেঁটে লোকটা চোখের ইঙ্গিত করল। দানবটা গিয়ে আলমারি খুলল। পুরনো কাগজপত্র আর কিছু ফাঁইল আজও অযত্নে পড়ে আছে চারটে তাকে। দানবটা ঝটপট সব কাগজপত্র নামাল। ঘন্টাখানেক ধরে তন্ন-তন্ন করে খুঁজল। তারপর রক্ত-জল করা ভয়াল চোখে তাকাল বাঞ্ছারামের দিকে।
বেঁটে লোকটার ভুরু কোঁচকানোই ছিল, এবার হঠাৎ চোখে একটা রাগের বিদ্যুৎ খেলে গেল। চাপা গলায় চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, “জিনিসটা আলমারিতে নেই। তুমি কি আমাদের সঙ্গে রসিকতা করছ?”
বাঞ্ছারাম নিজের কপাল টিপে ধরে ভয়ার্ত গলায় বললেন, “আমার যে কিছু মনে থাকে না। কী করব?”
দানবের মতো লোকটা রবারের হোস হাতে এগিয়ে এল। বাঞ্ছারাম ভয়ে কুঁচকে যাচ্ছিলেন। চোখে অবোধ দৃষ্টি। কিছুতেই মনে পড়ছে না, ফরমুলাটা কোথায় রেখেছেন।
দানবের হাতের রবারের হোসটা তাঁর বাঁ হাতে একটা মুগুরের মতো এসে লাগল। বাঞ্ছারামের মনে হল হাতটা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল বুঝি। কনুই থেকে সমস্ত হাতটা অসাড় হয়ে ঝিনঝিন করতে লাগল। চোখে লাল নীল হলুদ ফুলঝুরি দেখতে লাগলেন। “বাবা গো” বলে একটা অস্ফুট আর্তনাদ করলেন। মুখটা বেঁকে গেল ব্যথার তাড়নায়। ঠোঁট দিয়ে গাজলা বেরোতে লাগল। চোখ উল্টে গেল।
দানবটাই ট্যাপ থেকে এক কোষ জল এনে ঝাঁপটা দিলে মুখে। বাঞ্ছারাম চোখ খুললেন। বেঁটে লোকটা ঠাণ্ডা গলায় বলল, “তোমার মতো বিখ্যাত লোককে মারধোর করতে আমাদের খারাপ লাগছে। কিন্তু এটাও সত্যি যে, তুমি আগুন নিয়ে খেলা করছ। তোমার আবিষ্কার যদি তোমার কাছেই লুকোনো থাকে, তবে তা দিয়ে পৃথিবীর মঙ্গল হবে না। পৃথিবীর স্বার্থেই তোমার আবিষ্কারটা আমাদের জানা দরকার।”
বাঞ্ছারাম ছেলেমানুষের মতো আদুরে গলায় বললেন, “আমি দিদির কাছে যাব। আমি রসগোল্লা খাব।”
বেঁটে সাহেবটা রসগোল্লা চেনে না। বয়স্ক লোকের দিদির কাছে যাওয়ার বায়নাও তার বোঝার কথা নয়। উপরন্তু বাঞ্ছারাম কথাটা বললেন বাংলায়। তারপর ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে
লাগলেন।
শত্রুপক্ষ তাঁকে কাঁদার জন্য মিনিট পাঁচেক সময় দিল। তারপরই দানবটা এসে তাঁর ডান কব্জিটা চেপে ধরল। কিন্তু তা সাধারণ চেপে ধরা নয়। যে কায়দায় ধরল, তাকে বলে জুড়োস থাম্ব লক। শিরা স্নায়ু ইত্যাদি নিরিখ ব্রা ধরা। একটু চাপ দিলেই গা দিয়ে ঘাম ছাড়ে, প্রাণ বলে পালাই-পালাই, শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। চাপ আর-একটু বাড়ালে যে-কোনো মজবুত কব্জি ভেঙে বা অকেজো হয়ে যেতে পারে। বাঞ্ছারাম মূক যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন। এই শীতেও তাঁর পাঞ্জাবি ভিজে গেল ঘামে। মাথা ঘুরতে লাগল, বমি বমি ভাব হতে লাগল।
দানবটা বলল, “বলো! বলো! শিগগির বলো!” কিন্তু কী বলবেন বাঞ্ছারাম? তাঁর পাগলাটে মাথায় ঘোলা জলের মতো আবছা হয়ে গেছে স্মৃতি। তাঁর ঠোঁট নড়তে লাগল। তিনি বলতে চাইলেন, “মেরো না! আর মেরো না! ছেড়ে দাও।”
আবার বুকের ওপর মাথা ঝুঁকে পড়ল বাঞ্ছারামের। মুখে গাজলা। চোখ ওল্টানো। আবার জলের ঝাটকা।
কিন্তু জ্ঞান ফিরলেও আতঙ্কে বাঞ্ছারাম বোধবুদ্ধিহীন হয়ে গেছেন। তার ওপর শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। ঘাড় ছিঁড়ে পড়ছে, দুটো হাতই অনড় হয়ে গেছে ব্যথায়। চোখ-ভরা জল।
বেঁটে লোকটা চেয়ার থেকে নেমে সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, “আমরা খবর রাখি, তোমার পাগলামিটা অভিনয় মাত্র। অনেক দিন ধরেই তুমি পাগল সেজে আছ। কাজেই আমাদের সঙ্গে অভিনয়ের চালাকি কোরো না। মনে রেখো, এখানেই ব্যাপারটা শেষ হবে না। আমরা তোমার ছেলেকে তোমার সামনে খুন করব। আর আমরা যা বলি, তাই করি।”
বাঞ্ছারাম ককিয়ে উঠলেন বিভীষিকা দেখে। গোঙাতে গোঙাতে বললেন, “ফরমুলাটা কোথাও আছে। আমার ছেলেকে মেরো না। বড় ছোট্ট ছেলে, মা-মরা দুঃখী ছেলে। তাকে মেরে না।”
বেঁটে লোকটা কব্জির ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, “তোমাকে চব্বিশ ঘন্টা সময় দিচ্ছি। কাল ঠিক এই সময়ে আমরা আসব। রাত দেড়টা নাগাদ। যদি তখন আমরা জিনিসটা হাতে না পাই, তাহলে যা হওয়ার তাই হবে। পুলিসকে বা আর কাউকে খবর দিও না। তাতে লাভ নেই।”
বাঞ্ছারাম মাথা নাড়লেন। মুখে কথা আসছিল না। বামন আর দানব নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।
পরদিন যখন ল্যাবরেটরিতে এসে তাঁকে আবিষ্কার করল রঘু, তখন তাঁর একশ তিন ডিগ্রী জ্বর। চোখ টকটক করছে লাল। অবিরল ভুল বকছেন, “রতনকে ওরা মেরে ফেলবে। ফরমুলাটা কোথায়? ফরমুলাটা?”
ডাক্তার এসে ওষুধ দিল। তাঁর হাতে পায়ে কোনো কালশিটে বা চোখে পড়ার মতো মারের দাগ নেই। শুধু দুটো হাতই আড়ষ্ট আর সামান্য ফোলা। ডাক্তার তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে চলে গেল।
দুপুরে ঘুম ভাঙল বাঞ্ছারামের। জ্বর একটু কম, ব্যথা থাকলেও অসহ্য নয়। ঘুম থেকে জেগে অসহায়ের মতো সিলিং-এর দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। কী করবেন? ফরমুলাটা যে কোথায়, তা তাঁর জানা নেই।
বাঞ্ছারাম কষ্টেসৃষ্টে উঠলেন। তারপর ল্যাবরেটরিতে এসে চুপ করে বসে রইলেন। খুব মন দিয়ে ভাববার চেষ্টা করলেন বহুদিন আগেকার ঘটনাটা। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না।
রাতে খেয়ে-দেয়ে শুতে গেলেন। কিন্তু ঘুম এল না। গভীর রাতে চুপিচুপি উঠে এলেন ল্যাবরেটরিতে। অন্ধকার ল্যাবরেটরি। দরজায় আজ তালা নেই। কেবল ভেজানো। ভিতরে পা দিলেন। আলোর সুইচের দিকে হাত বাড়িয়েছেন, কিন্তু ছুঁতে পারলেন না। তার আগেই একটা ভোয়ালে এসে তাঁর মুখ চেপে ধরল। তিনি জ্ঞান হারালেন।