বিজ্ঞান-গবেষণা! শুনে চমকে উঠল রতন। বলল, “আমার বাবা যে বিজ্ঞানের গবেষণা করতেন, সে কথা তোমরা জানলে কী করে?”
“তোমার সম্পর্কে আমরা সবরকম খোঁজ-খবর নিয়েছি।”
রতন বলল, “আমেরিকায় যাওয়ার অনেক খরচ। সে-টাকা কে দেবে?”
“আমি দেব। আমেরিকায় আমি হব তোমার ম্যানেজার। তুমি যখন বক্সিং থেকে অনেক টাকা রোজগার করবে, তখন এই টাকা শোধ হয়ে যাবে। ওটা নিয়ে ভেবো না।”
“তুমি কি আমেরিকান?”
জন ম্লান হেসে মাথা নাড়ল, “না। আমি আমেরিকান নই। আমি পৃথিবীর সব ধনী দেশের শত্রু।”
“তার মানে?”
“মানেটা আস্তে-আস্তে বুঝতে পারবে। তবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে শত্রুতা করতে হলে তেমনি শক্তিশালী অস্ত্র চাই। শুধু বক্সিং দিয়ে তো ওদের ঘায়েল করা যাবে না।” বলে জন একটু হাসল। তারপর বলল, “কথাগুলো তোমার কাছে ধাঁধার মতো লাগছে, না?”
রতন মাথা নেড়ে বলল, “হয়তো আমি ইংরিজি ভাল জানি না বলেই তোমার সব কথা বুঝতে পারছি না।”
জন মাথা নেড়ে বলল, “ইংরিজির দোষ নেই। তুমি তো খুব সুন্দর ইংরিজি বলো। বোধহয় ভালো কোনো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েছ, তাই না?”
রতন মাথা নিচু করে বলল, “হ্যাঁ।”
“তোমাদের ইংরিজি ভাষার প্রতি একটা হ্যাংলামি আছে। তা হোক, ইংরিজি ভাষা তোমার বিস্তারে সাহায্য করবে। সেই সঙ্গে যদি ইংরেজদের গুণগুলো পেতে তাহলে আরো ভাল হত।”
রতন লজ্জায় একটু রাঙা হল। বলল, “তোমার কি আর কোনো কথা আছে?”
জন গম্ভীর গলায় বলল, “আছে, তোমার বাবা যখন পাগল হয়ে যান তখন তিনি কোন্ বিষয়ে গবেষণা করছিলেন তা কি তুমি জানো?”
“না। বাবার যখন মাথা খারাপের লক্ষণ দেখা দিচ্ছিল তখন আমি খুব ছোট।”
জন গলাটা একটু খাটো করে বলল, “সেই সময়ে তোমার বাবার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল। তাকে তোমার মনে আছে?”
রতন বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বলল, “বাবার সঙ্গে আমার তেমন যোগাযোগ ছিল না। আমি দিল্লির একটা ভাল স্কুলে পড়তাম, থাকতাম বোর্ডিং-এ। তবে শুনেছি বাবার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল, তার নাম বোধহয় ছিল রাব্বি।”
জন একটা বড় শ্বাস ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ। রবিন ফরডাইক; ওদের পরিবার ছিল জার্মান ইহুদি।”
“আমি অত জানি না। রাব্বিকে আমি দেখিনি।”
জন মৃদুস্বরে বলে, “তোমার বাবা যখন আমেরিকায় ছিলেন, তখন রবিনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটে। রবিন বা রাব্বি খাঁটি ইহুদি নয়। তার মা ছিল ব্যাংককের মেয়ে। রবিন যেমন মেধাবী তেমনি ধূর্ত। সে ভেবেছিল তোমার বাবাকে ভাঙিয়ে সারা দুনিয়া জুড়ে একটা একচেটিয়া ব্যবসা করবে।”
রতন হাঁ করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “আমি তো এতসব জানি না। শুধু শুনতে পাই আমার বাবাকে তাঁর এক অ্যাসিস্ট্যান্ট নাকি কী একটা ওষুধ খাইয়ে পাগল করে দিয়েছিল।”
জন বলল, “হতে পারে। তবে যে-উদ্দেশ্যে রবিন তোমার বাবার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়েছিল তা সফল হয়নি। তুমি বিজ্ঞানের কিছু জানো?”
“খুব সামান্য। বাবা পাগল হয়ে যাওয়ায় আমি বেশিদূর
পড়াশুনো করতে পারি নি। সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ করি।”
“তবু এটা তো জানো যে, সারা দুনিয়ায় এখন একটা এনার্জি ক্রাইসিস চলছে!”
“কিছুটা জানি। মাটির নীচে খনিগুলির কয়লা ফুরিয়ে আসছে, শেষ হয়ে আসছে পেট্রোলিয়ম, পারমাণবিক শক্তির জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডারও অফুরন্ত নয়।”
“বাঃ, তবে তো অনেকটাই জানো। আর এই শক্তি বা তাপের যে দুর্ভিক্ষ দুনিয়ায় শিগগিরই দেখা দেবে তার জন্য বিশ্বের সব ছোটবড় রাষ্ট্রই যে সমুদ্র বা সূর্যরশ্মি থেকে বিকল্প শক্তি তৈরি করার চেষ্টা করছে, তাও তো জানো!”
“জানি। তবে সে কাজে মানুষ এখনো সম্পূর্ণ সফল হয়নি।”
“ঠিক। তোমার বাবা যে গবেষণাটা করছিলেন, তাও এই এনার্জি নিয়েই। তিনি অবশ্য কোনো বিকল্প শক্তি আবিষ্কারের চেষ্টা করছিলেন না। তবে তিনি সফল হলে দুনিয়া থেকে চিরকালের মতো এনার্জি ক্রাইসিস বিদায় নিত।”
“সেটা কী জিনিস?”
“তাঁর কাজটার নাম ছিল হিট অ্যামপ্লিফিকেশন। নামটা অবশ্য খুব সুন্দর নয়, কিন্তু কাজটা ছিল দারুণ গুরুতর।”
“কী রকম?”
“শব্দকে যেমন অ্যামপ্লিফায়ারে বহুগুণ বাড়ানো যায়, তেমনি তাপকেও হয়তো বাড়ানো সম্ভব। তাপ বিবর্ধন নিয়েও সারা দুনিয়ায় গবেষণা চলছে। কিন্তু আমরা খবর রাখি, তার মধ্যে তোমার বাবাই লক্ষের খুব কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন। শেষ পর্যন্ত হয়তো সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক সেইসময়ে একটা গুরুতর কিছু ঘটে যায় এবং তিনি পাগল হয়ে যান। রবিনও তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে যায়।”
লোকটা ভাল না খারাপ তা বুঝতে পারছে না রতন। ওর মতলবটা কী তাও সে এখনো সঠিক জানে না। তবে তার বাবার আবিষ্কার সম্পর্কে যে এ-লোকটা খবর রাখে, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।
রতন বলল, “অতীত নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী হবে? যা চুকেবুকে গেছে তা আবার খুঁচিয়ে তুলতে আমার খারাপ লাগে।”
জন একটু হাসল। তারপর বলল, “ভারতীয়রা সব ব্যাপারেই একটু উদাসীন আর নির্লিপ্ত থাকতে ভালবাসে। আর তার জন্যই ভারতের উন্নতি ঘটেনি, ঘটবেও না। কিন্তু আমরা যারা বেঁচে থাকতে ভালবাসি এবং দুনিয়াকে দখল করার স্বপ্ন দেখি, তারা সহজে কিছু ছেড়ে দিতে রাজি নই। তোমার বাবা কেন পাগল হলেন বা তাঁর আবিষ্কারের মূল্য কতটা তা জানার আগ্রহ তোমার থাকা উচিত। তিনি যদি সত্যিই হিট অ্যামপ্লিফায়ার আবিষ্কার করে থাকেন তবে তার দাম এখনকার দুনিয়ায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। তুমি মহম্মদ আলির মতো বড় বক্সার হলেও কোনোদিন তো ডলার রোজগার করতে পারবে না।”