খবর এল, সুব্বার চোয়ালের হাড় ভেঙেছে, সে এখন হাসপাতালে। বক্সিং জিনিসটা এরকমই। প্রতিপক্ষকে কখনো অবহেলা করতে নেই। প্রতিপক্ষকে অবহেলা করে জো লুই তাঁর সবচেয়ে খ্যাতির সময়ে জার্মানির স্মেলিং-এর কাছে হেরে যান। প্যাটারসন হেরে গিয়েছিলেন সুইডেনের অখ্যাতনামা জোহানসনের কাছে। এমন কী, মহম্মদ আলিকেও স্পিংকসের মতো নাবালক মুষ্টিযোদ্ধার কাছে মাথা নোয়াতে হল এই তো সেদিন।
এত অল্প বয়সে অপ্রত্যাশিত এত বড় একটা লড়াই জিতেও রতনের তেমন আনন্দ হয় না। আসলে আনন্দ পাওয়ার মতো মনটাই তার হারিয়ে গেছে। কারণ তার এই জয়ে খুশি হওয়ার মতো আপনজন কেউ তো নেই। তার মা মারা গেছেন, বাবা পাগল, এক দিদি বিয়ের পর কণাটকের এক শহরে থাকে, দেখাই হয় না তার সঙ্গে। তাছাড়া রতনরা খুবই গরিব। বক্সিং করে বলে রতন একটা সামান্য চাকরি পেয়েছে। সেই টাকায় খুব কষ্টেই চলে তাদের।
অথচ কষ্টের কারণ ছিল না। তার বাবা ছিলেন একজন নামকরা বৈজ্ঞানিক। কী একটা বস্তু আবিষ্কার করার ভূত চেপেছিল তাঁর মাথায়। তাই নিয়ে দিনরাত ভাবতে ভাবতে একদিন পাগলামি দেখা দিল। অবশ্য অনেকে বলে তাঁর একজন সহকারী ছিল। সেই নাকি ওঁর মাথা খারাপ করে দিয়েছিল ওষুধ খাইয়ে। এখনো নিজের ল্যাবরেটরিতেই দিনরাত তিনি কাজ করেন। তবে সে কাজ পাগলামিরই নানারকম খেয়াল খুশি। রতনের এক বুড়ি পিসি তাঁর দেখাশোনা করেন। আর কেউ নেই।
রাত্রিবেলা সবাই ঘুমোলে পর রতন আজ একা বাইরে এসে দাঁড়াল। প্রচণ্ড শীত। সে একবার আকাশের দিকে তাকাল। বুকটা হু-হুঁ করে উঠল হঠাৎ। চোখে এল জল। এই পৃথিবীতে তার মতো হতভাগা আর কে আছে, যার জীবনে একটা আনন্দের ঘটনা ঘটলেও সে-আনন্দের ভাগিদার কেউ নেই?
নির্জন আলো-আঁধারে মাঠের ওপর দাঁড়িয়ে রতন একটু দূরের স্টেডিয়ামটা দেখতে পাচ্ছিল। দেখতে দেখতে লড়াইয়ের দৃশ্য ভেসে উঠছিল চোখে। হঠাৎ তখন সেই দুটো লোকের কথাও মনে পড়ল তার।
ওরা কী চায়? তাকে অনুসরণই বা করছে কেন? ওরা ভাল লোক, না মন্দ লোক? লড়াইয়ের সময় ওরাই কি নানারকম পরামর্শ দিচ্ছিল তাকে?
এইসব ভাবতে-ভাবতে আনমনে রতন চোখ ফেরাতেই তার শরীরটা শক্ত হয়ে গেল হঠাৎ। বক্সারের মজবুত হৃৎপিণ্ডও যেন একটু ধুকপুক করে উঠল। তার ডানদিকে একটু দূরে মাঠের ওপর সেই দুই মূর্তি পাথরের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছে।
২. ধীর পায়ে দুজন এগিয়ে এল
ধীর পায়ে দুজন এগিয়ে এল। লম্বা লোকটি ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ইংরিজিতে বলল, “কগ্র্যাচুলেশন্স। তুমি খুব ভাল বক্সার।”
রতন অবাক হয়েছিল ঠিকই। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে লোকটার সঙ্গে করমর্দন করে ইংরিজিতে বলল, “ধন্যবাদ। কিন্তু তোমরা কারা? বিদেশী?”
লম্বা লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক ধরেছ। আমরা বিদেশী। আমার নাম জন, আর আমার এই বন্ধুর নাম রোলো।”
ভদ্রতাবশে রতন রোলোর দিকে হাত বাড়াচ্ছিল। কিন্তু জন টপ করে তার হাতটা ধরে ফেলে বলল, “ও কাজ কোরো না। রোলোর কোনো সৌজন্যবোধ নেই।”
রতন ভাল করে তাকিয়ে দেখল, রোলোর মুখে একটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর নির্দয়তার চিহ্ন আছে। চোখ দুটো আধবোজা এবং পলকহীন। মুখে কেমন একটা বোকা-বোকা ভ্যাবলা ভাব। রোলোর দিকে তাকালে খুব সাহসী লোকেরও অজ্ঞাত কারণে একটু গা ছমছম করবে।
জন বলল, “তোমাকে এত রাতে বিরক্ত করতে এসেছি বলে কিছু মনে কোরো না। তোমার সঙ্গে আমাদের একটু গোপনে দেখা করা দরকার ছিল। আমরা বিদেশী, তাই সহজেই অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। গভীর রাত ছাড়া উপায় ছিল না।”
রতন একটু হেসে বলল, “কিন্তু এখন তো আমার ঘুমিয়ে থাকার কথা। আজ ঘুম আসেনি বলে আমি বাইরে এসেছিলাম। এলে তোমরা কী করতে!”
জনও হাসল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, “তুমি বাইরে না এলে আমরা তোমার ঘরে যেতাম। আমাদের দরকারটা জরুরি।”
রতন আগাগোড়া একটা অস্বস্তি বোধ করছে। সে স্পষ্টই বুঝতে পারছে, এরা খুব সহজ সাধারণ লোক নয়। বক্সিং করতে গিয়ে রতনকে সাহেব-সুবোর সঙ্গে অনেক মিশতে হয়েছে। এরা দুজন তাদের মতো নয়। এদের চারদিকে একটা রহস্যের ঘেরাটোপ রয়েছে।
রতন হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি, তোমরা বক্সিং দেখে বেড়াচ্ছ নানা জায়গায়। তোমরা কি বক্সিং ভালবাসো?”
“নিশ্চয়ই। আমরা সারা দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছি ভাল প্রতিভাবান ন্যাচারাল বক্সার খুঁজে বের করতে। তোমার মধ্যে আমরা সেইরকম একজনকে খুঁজে পেয়েছি।”
রতন একটু অবাক হয়ে বলল, “আর সেই জন্যই এত রাতে আমার কাছে এসেছ?”
জন মৃদু হেসে বলল, “অনেকটা তাই। আমরা তোমাকে আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে প্রফেশন্যাল বক্সিং-এ নামাতে চাই।”
আমেরিকায় যাওয়ার কথায় রতন খুশি হয় ঠিকই, কিন্তু সেইসঙ্গে আর একটা কারণে তার মন খারাপ হয়ে যায়। সে বলে, “কিন্তু আমার বাবাকে ফেলে আমেরিকায় যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার বাবা পাগল। তাঁকে খাওয়াবে পরাবে কে?”
জন একটু চুপ করে থেকে বলে, “শুনে দুঃখ পেলাম। তবে তুমি যদি চাও তো তোমার বাবাকেও আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি। সেখানে মানসিক রুগিদের ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। তোমার বাবা হয়তো সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন। এবং তাঁর বিজ্ঞান-গবেষণা আবার শুরু করতে পারবেন।”