রতন দড়ির সেই খেলা জানে না। আলির পক্ষে যা সম্ভব, তা কি যে-কেউ পারে? কিন্তু মজা হল রিং-এর দড়িটা তার পিছন দিকে স্প্রিং-এর মতো কাজ করছে। দড়িতে একটা স্কুল খেয়ে।
দেখবে নাকি?
সুব্বার আর-একটা জ্যাব বুকের ডান ধারে লাগতেই দম বন্ধ করে রতন পিছন দিকে প্রচণ্ড গতিতে একটা ধাক্কা দিল। দড়িটা ম্প্রিং-এর মতোই তাকে উল্টে ছুঁড়ে দিল ভিতর দিকে। রতন ছিটকে সরে এল ভিতরে।
সুব্বা ঘুরে দাঁড়াতেই রতন তার প্রথম ঘুষিটা জমাতে পারল। বেশ জোরালো এবং মোক্ষম মার। সুব্বার কপালের ঠিক মাঝখানটায়।
সুব্বা একটু পিছিয়ে গেল মাত্র। আর কিছু নয়। রতন স্পষ্ট শুনল, তার ডান-পাশ থেকে কে যেন বিরক্তির গলায় বলছে, “লেফট! ইউজ ইয়োর লেফট!”
হুশ করে একটা প্রচণ্ড শ্বাস ছাড়ল রতন। সুব্বা আর একতরফা মারছে না। সরে গেছে। ঘুরছে নেচে-নেচে।
হঠাৎ রতন দেখতে পেল, সুব্বার কপালের মাঝখানটা কেটে গেছে। সামান্য একটা রক্তের রেখা নেমে এসেছে সাদা কপাল বেয়ে নাকের ওপর। তার ঘুষিটা বৃথা যায়নি।
আড়ষ্ট ঠোঁটে আপনমনেই একটু হাসল রতন। দুনিয়ায় অপরাজেয় কেউ নেই।
প্রথম রাউন্ড শেষ হতে বাকি ছিল না বেশি। ঘন্টা পড়া-পড়া প্রায়। ঠিক সেই সময়ে সুব্বা তার ওস্তাদের মারটি মারল।
অভিনয়টা ছিল চমৎকার। দুটো ভুয়ো ঘুষি চালিয়ে কয়েকটা পয়েন্ট সংগ্রহ করে পিছিয়ে যাওয়ার সময় আচমকাই সে শরীরে একটা মোচড় দিয়ে দুম করে একটা আপার কাট চালিয়ে দিল।
ঘুষিটা লাগলে রতনকে উঠতে হত না আজ। কিন্তু লাগার আগেই আবার সেই দৈববাণী, “হি ইজ ফেইনিং। গেট আউট অফ হিজ রীচ।”
অর্থাৎ, ও অভিনয় করছে, ওর নাগাল থেকে সরে যাও।
রতন সরল ঠিকই, তবে একটু খেলিয়ে। সুব্বাকে সে ঘুষিটা তৈরি করতে দেখল। ঘুষিটা আসছে, তাও দেখল। তারপরই টুক করে মাথাটা নামিয়ে ঘুষিটাকে বইয়ে দিল মাথার ওপর দিয়ে। আর তক্ষুনি দেখতে পেল তার ডান হাতের সোজাসুজি সুব্বার থুতনি। অরক্ষিত এবং অসহায়।
এই সুযোগটাকে কাজে না লাগায় কোন্ বোকা? স্বয়ংক্রিয় ভাবেই রতনের ডানহাত পিস্টনের মতো পিছনে সরে এসেই হাতুড়ির মতো গিয়ে পড়ল সুব্বার চোয়ালে।
এত জোরালো ঘুষি রতন জীবনে কাউকে মারেনি। তার কব্জি ঝন্ঝন্ করে উঠল আঘাতের প্রতিক্রিয়ায়।
কিন্তু সুব্বা বক্সার বটে। ঘুষিটা খেয়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। পড়ে গেল না। মুখে বিস্ময়, চোখে অবিশ্বাস। দুই গ্লাভসবদ্ধ হাত দুদিকে ঝুলছে। ভ্রূ কুঁচকে সে সামনের দিকে চেয়ে যেন খুব কষ্টে কিছু দেখবার চেষ্টা করল।
রতনও হাঁ করে চেয়ে ছিল। ঐ ঘুষি খেয়েও যদি সুব্বার কিছু হয়, তবে ধরে নিতে হবে সুব্বাকে হারানো অসম্ভব। হা ঈশ্বর।
কিন্তু সুব্বা দাঁড়ানো অবস্থায় রইল কয়েক সেকেন্ড। চোখের দৃষ্টি চকচকে হয়ে শুন্য হয়ে গেল হঠাৎ। হাঁটু ভাঁজ হয়ে শরীর ধীরে-ধীরে ভেঙে পড়ল মেঝের ওপর।
কে যেন দানবীয় স্বরে পিছন থেকে প্রম্পট করছিল, “হিট হিম। হিট হিম এগেন।”
কিন্তু ঐ মহান বক্সারকে ওরকম অসহায় অবস্থায় আর একটি ঘুষিও মারতে বাধল রতনের। সুব্বা তার ঘুষি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে, এটাই তো তার জীবনের এখন পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ ঘটনা।
রেফারী গুনতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু রাউন্ড শেষ হওয়ার ঘন্টা পড়ায় সুব্বা নক আউট হল না। তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বসানো হল টুলে।
রতনকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে চিত্তব্ৰত বলল, “ভাবা যায় না কী তুমি করেছ। ও।”
অ্যান্টিসেপটিকে-ভেজানো তুলোয় ক্ষতস্থান জ্বালা করে উঠল রতনের। তবু সে একটু তৃপ্তির হাসি হাসল। পৃথিবীতে কেউই অপরাজেয় নয়। তবে সুব্বা এখনো হারেনি। পরের রাউন্ডে আছে। তার পরের রাউন্ড আছে। সে চোখ বুজে রইল। হঠাৎ একটু চমকে উঠল সে। চিত্তব্রতর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “চিত্তদা, আপনি আমাকে ডিরেকশন দিচ্ছিলেন?”
চিত্তব্রত অবাক হয়ে বলে, “না তো?”
রতন হঠাৎ সোজা হয়ে বসে ডানদিকে তাকাল। না, রিং-এর ধারে বসা সেই দুই মূর্তি নেই। দুটি চেয়ার ফাঁকা পড়ে আছে।
দর্শকদের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সুব্বাকে ঘিরে অনেক লোক। ক্লান্তিতে চোখ বুজল রতন।
দ্বিতীয় রাউন্ডের ঘন্টা পড়তেই রতন টুল ছেড়ে উঠল। কিন্তু সুব্বা উঠল না। তাকে তখনো দুজন লোক পরিচর্যা করছে। সুব্বার চোখ বোজা, ঘাড় হেলানো।
রতন যখন অপেক্ষা করছে, তখন সারভিসেসের ম্যানেজার রেফারীর কাছে এসে মৃদুস্বরে কী একটু বলে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বিস্ময়-ভরা চোখে রতনকে দেখে গেলেন।
রেফারী যখন এগিয়ে এসে রতনের একখানা হাত উর্ধ্বে তুলে তাকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করলেন, তখনো রতন বুঝতে পারছিল না ব্যাপারটা কী হল, দর্শকরা কিন্তু তখন পাগলের মতো চেঁচাচ্ছে, লাফাচ্ছে আনন্দে, কয়েকজন রিং-এর মধ্যে ঢুকে রতনকে কাঁধে নিয়ে একপাক ঘুরলও।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে রতনের মাথায় ঢুকল যে, সে প্রথম রাউন্ডেই টেকনিক্যাল নট-আউটে সুব্বাকে হারিয়ে লাইট হেভিওয়েটে এবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
চিত্তদা এসে একটা তোয়ালে জড়িয়ে রতনকে টেনে নিয়ে গেলেন ড্রেসিং রুমে। বাংলার অন্যান্য মুষ্টিযোদ্ধারা রতনকে আদরে-আদরে অস্থির করে তুলল। সারভিসেসের ম্যানেজার স্বয়ং এসে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন। বলে গেলেন, ইফ ইউ ওয়ান্ট টু জয়েন দি সারভিসেস, জাস্ট সে ইট।